কলকাতা, ৪ জুলাই (হি. স.): প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে গতি বৃদ্ধি এবং চাহিদা ও যোগানের মধ্যে বেড়ে ওঠা ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে ১০৯ টি রুটে বেসরকারি ট্রেন পরিষেবা চালু করার ঘোষণা করেছে ভারতীয় রেল। এতে করে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে রেল পরিষেবায়। কিন্তু আদৌ তাতে করে সাধারণ মানুষের উন্নতি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান অর্থনীতিবিদরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অজিতাভ রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে রেল হচ্ছে অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র। এক রাজ্য থেকে অন্যত্র যাওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক জনগণ রেলের প্রতি নির্ভরশীল।রেলের বেসরকারিকরণের আগে নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারীদের চিহ্নিত করে তাদের থেকে নেওয়া ভাড়া নির্দিষ্ট পরিমাণে বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল। বেসরকারিকরণের পরে এই পদক্ষেপ তাদের জন্য রক্ষাকবচের মতন কাজ করতো।ভাড়া নিয়ে আয়ের ভিত্তিতে এই বিভাজন ভারতের মতন তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রয়োজন ছিল। প্রশাসনিক সদিচ্ছা থাকলে এটি করা যায়। এমনকি ক্ষুদ্র, কুটির শিল্পের ক্ষেত্রেও রেলের তরফে ভাড়ার দিক থেকে রক্ষাকবচ দেওয়া উচিত।কারণ বেসরকারিকরণ হলে ভাড়া বৃদ্ধি হওয়ার প্রবণতা থেকেই যায়।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বর্ষীয়ান এই অর্থনীতিবীদ জানিয়েছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।আগে ১০০ শতাংশ উৎপাদন হলে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে ৩০ শতাংশ থাকত। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। রেল যে বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে সেটা স্বাভাবিক।কিন্তু রেলে ভাড়ার ক্ষেত্রে আয় ভিত্তিক বিভাজন করে রক্ষাকবচ দিতে না পারলে বিপদের মুখে পড়বে নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ। এর সবথেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি। অনেক উচ্চবিত্ত উচ্চ-মধ্যবিত্ত রয়েছে যাদের তিন চারটা করে গাড়ি থাকে।তাদের কাছে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়াটা খুব একটা অসুবিধার নয়।কিন্তু যে সকল মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ফুড ডেলিভারি বয়রা বাইকে যাতায়াত করে তাদের কাছে পেট্রোল,ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি একটা বাড়তি চাপ হিসেবে কাজ করে থাকে।
সম্প্রতি রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বি কে যাদব জানিয়েছিলেন যে ১০৯ রুটে ১৫৯ টি ট্রেন পরিষেবা বেসরকারিকরণ করা হলেও রেলের ৯৫ শতাংশ কর্মকাণ্ড কেন্দ্রের হাতেই থাকবে। ফলে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।বিগত সত্তর বছরে সাধারণ মানুষকে রেলের তরফ থেকে যে যাত্রী সাচ্ছন্দ দেওয়ার কথা ছিল তা দিতে পারেনি ভারতীয় রেল।তাই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
রেলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কংগ্রেস, বামফ্রন্ট সহ একাধিক রাজনৈতিক দল কেন্দ্রের নিন্দায় সরব হয়েছে। কিন্তু রেল বোর্ড বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে অবিচল।কয়েক মাসের মধ্যেই এই বিষয়ে দরপত্র ডাকা হবে।২০২৩ সালের মধ্যে বেসরকারি রেল পরিষেবা চালু হয়ে যাবে।কিন্তু বেসরকারিকরণ হলেই যে যাত্রী স্বচ্ছন্দ বাড়বে তা নিয়ে সন্দিহান শ্রীরামপুর কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক দিব্যেন্দু বন্দোপাধ্যায়।
তার মতে বর্তমানে রেলের পাঁচ শতাংশের বেসরকারিকরণের কথা বললেও আগামী দিনে বেসরকারিকরণের পরিমাণ বাড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত মনোপলি (একচ্ছত্র) কথাটা বললেই সবার আগে আসত রেলের প্রসঙ্গ।অর্থনীতির পড়ুয়াদের এর উদাহরণ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন থেকে আর এর উদাহরণ দেওয়া যাবে না। বেসরকারি বিনিয়োগ হলে লাভ-লোকসানের খতিয়ান দেখা হবে। ভাড়া বৃদ্ধি সহ অন্যান্য পরিষেবা খরচ বাড়বে। প্রশাসনের কোষাগারে বেশি অর্থ আসবে।কিন্তু রেলকে বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দিয়ে আদতে দায় এড়িয়ে এড়াচ্ছে প্রশাসন। বেসরকারিকরণ হলেই যে ভাল হবে তার কোন মানে নেই। এর সবথেকে বড় উদাহরণ আইআরসিটিসি। বর্তমানে দূরপাল্লার ট্রেনগুলিতে খাবারের মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেশের এখনও সিংহভাগ মানুষ রেলের প্রতি নির্ভরশীল। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে অন্যান্য যাতায়াতের মাধ্যম থেকে রেলের ভাড়া এখনও নিম্নমধ্যবিত্ত ও দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের নাগালের মধ্যে।
রেলের বেসরকারিকরণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন রেলের প্রাক্তন সিপিআরও সমীর গোস্বামী।তার কথায়, ভারতীয় রেলের সূত্রপাতের সময় মূল লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ এবং সার্বিক উন্নয়ন। বেসরকারিকরণ হলে মুনাফার লক্ষ্যে এই উদ্দেশ্য বদলে যেতে পারে। ইউরোপে একাধিক রুটে বেসরকারীকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে তার মধ্যে বেশিরভাগেরই পরিষেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
বেসরকারিকরণের দিকে রেলকে কেন হাঁটতে হল তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমীরবাবু জানিয়েছেন, আর্থিক দিক দিয়ে রেলকে অচল করে তুলেছে রাজনীতিবিদরা।রেলের সার্বিক উন্নয়নের কথা না ভেবে শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে এই ক্ষেত্রটি ব্যবহৃত হয়েছে। যে রাজ্যে নেতা রেলমন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন রেলের যাবতীয় উন্নতি সেই রাজ্যের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে।জনমোহিনী নীতির জন্য দীর্ঘ সময় ধরে রেলের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী লোকসভায় দেওয়া ভাষণকে উদ্ধৃত করে প্রাক্তন এই রেল কর্তা জানিয়েছেন, রেল আইসিইউতে ঢুকে গেছে। বর্তমান সময়ে এই অভ্যাস যে পাল্টায়নি সেই দিক নির্দেশ করে তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য আমেদাবাদে বুলেট ট্রেন প্রকল্প। মহারাষ্ট্রে রেলের উন্নতি হচ্ছে কারণ বর্তমান কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ওই রাজ্য থেকে উঠে আসা নেতা। রাজনীতিবিদরা রেলের লাইনে সম্প্রসারণ না করিয়ে ক্রমাগত নতুন ট্রেনের ঘোষণা করে গিয়েছেন। ফলে সার্বিক দিক দিয়ে রেলের গতি গিয়েছে কমে।
বেসরকারিকরণ করলেই যে সমস্ত সমস্যা মিটে যাবে তা মানতে পারছেন না সমীর বাবু। তার কথায় অসামরিক বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রে একাধিক বেসরকারি এয়ারলাইন্স রয়েছে।লাভের মুখ না দেখতে এদের মধ্যে অনেকেই ধুঁকছে। কথায় বলে রেল উন্নয়ন নিয়ে আসে। অর্থাৎ রেললাইনের বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণ হলে সামাজিক উন্নয়ন হতে বাধ্য। বাজার সহ নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে শহরাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করতে রেলের ভূমিকা অপরিসীম।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনী জনসভায় একাধিকবার নরেন্দ্র মোদী রেলের বেসরকারীকরণ এর পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছিলেন। তিনি এমন বলেছিলেন যে রেলের লাইনটা সরকারের হলেও ট্রেনগুলি চলবে বেসরকারি। ক্ষমতায় এলে তিনি যেই পদক্ষেপ নেবে সেটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষাই। কিন্তু এখনও ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেল লাইন নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলিতে রেল তার পর্যাপ্ত সম্প্রসারণ করেনি। ফলে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন না করে রেলের বেসরকারিকরণের যে আদৌ সুখকর হবে না, তা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।