গুয়াহাটি, ৫ মার্চ (হি.স.) : গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মেঘালয়ের পূর্ব খাসিপাহাড় জেলার শেলা বিধানসভা কেন্দ্ৰের সোহরা (চেরাপুঞ্জি) মহকুমার ইছামতি গ্রামে খাসি ছাত্র সংস্থা এবং অজনজাতিদের সংঘর্ষের দরুন প্রতিবেশী রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অসমের শতাধিক শ্ৰমিক আটকে পড়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া ২৭৯ জন শ্রমিককে পাঁচটি ট্রাকে করে স্পেশাল এসকোর্ট দিয়ে আন্তঃরাজ্য সীমান্তবর্তী জোড়াবাটে অসমের ফাঁড়ি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে মেঘালয় পুলিশ। এঁরা মধ্য অসমের কামরূপ, নিম্ন অসমের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বরপেটা, কোকরাঝাড়-সহ অন্য কয়েকটি জেলার বাসিন্দা।
হস্তান্তরের সময় জোড়াবাটে উপস্থিত ছিলেন অসম পুলিশের আইন-শৃঙ্খলা শাখার আইজিপি দীপক কুমার কেডিয়া-সহ অন্য বেশ কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ অফিসার। ছিলেন পূর্ব বিলাসীপাড়ার বিধায়ক অশোককুমার সিংঘি এবং সারা অসম গরিয়া মরিয়া দেশি জাতীয় পরিষদের কয়েকজন নেতা। তাঁরা ভুক্তভোগী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মেঘালয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতনের খবরাখবর নিয়েছেন। এখানে জোড়াবাট পুলিশ ফাঁড়িতে মেঘালয় থেকে আগত সব শ্রমিকের নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে যার যার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে অসম পুলিশ প্রশাসন।
এদিকে মেঘালয়ে সেদিনের সংঘর্ষ ও পরবর্তী পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বরপেটার বাসিন্দা জনৈক বহাব আলি জানান, গত পাঁচ দিন তাঁরা নিজেদের প্রাণ নিয়ে ওই রাজ্যের বিভিন্ন জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিলেন। বহু কষ্ট করে বিএসএফ-এর কোনও একজনের ফোন নম্বর জোগাড় করে তাঁকে ফোন করে সহায়তার আবেদন জানান তাঁরা। এর পর সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানরা নিরাপত্তা দিয়ে তাঁদের জঙ্গেল থেকে বের করে এনে সংলগ্ন থানায় সমঝে দেন। এই কয়দিন তাঁরা অনাহারে, বিনা পানীয় জলে কোনও রকম জীবন রক্ষা করেছেন।
মেঘালয় পুলিশের কাছে তাঁরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন কোকরাঝাড়ের বাসিন্দা সহিবুর আলি। তিনি জানান, তাঁরা কাজে ছিলেন। আচমকা সেদিনের ঘটনার পর কাজ বন্ধ করে মেঘালয় ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন মালিক। তাঁরা যেখানে কাজে ছিলেন সেখানে খাসি ছাত্র সংস্থার সদস্যরা অউপজাতিভুক্ত মানুষ দেখলেই মারধর করে বলে জানান চোখেমুখে আতংকগ্রস্ত সহিবুর। তিনি বলেন, বিএসএফ-এর জওয়ানরা সময়মতো না গেলে প্রাণ নিয়ে ফেরা সম্ভব হত না। আজ পাঁচটি ট্রাকে করে জন্তু-জানোয়ারের মতো মেয়েছেলে-সহ তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে, তা-ও জানান সহিবুর আলি। তাঁদের অনেকেই জানান, এখনও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক অসমের শ্রমিক আটকে রয়েছেন। ভয়ে আত্মগোপন করে আছেন তাঁরা।
শ্রমিকদের কীভাবে অসমে আনা হয়েছে, সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার উত্তরে আইজিপি (আইন-শৃঙ্খলা) দীপক কেডিয়া জানান, তাঁরা মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে টানা সম্পর্ক রক্ষা করছিলেন। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার রাতে খবর পাওয়ার পর ২৭৯ জন শ্রমিককে অক্ষত অবস্থায় অসমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। আজ অসমের প্রায় ১৪টি জেলার বাসিন্দাকে আনা হয়েছে। তবে মেঘালয়ে এখন পর্যন্ত কতজন অসমের বাসিন্দা-শ্রমিক আটকে রয়েছেন তার কোনও প্রকৃত হিসাব অসম পুলিশের হাতে নেই বলে জানান আইজিপি কেডিয়া। তবে মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে অসমের শ্রমিকদের খোঁজখবর নিতে জোড়াবাটে উপস্থিত পূর্ব বিলাসীপাড়ার বিজেপি বিধায়ক অশোককুমার সিংঘি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের তৎপরতায় অসমের পুলিশ প্রশাসন মেঘালয় পুলিশের সহায়তায় ওই রাজ্যে আবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি জানান, মেঘালয়ের ইস্ট খাসিপাহাড় জেলার সাইগ্ৰাফ থানায় ৩৫ জন কালাটেক রামকৃষ্ণ মিশন এলপি স্কুলের কাছে আটকে ছিলেন ২০ জন শ্ৰমিক। এছাড়া বিভিন্ন জঙ্গলে এখনও বহুজন আত্মগোপন করে রয়েছেন। তাদের কোনও পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের অনেকে কামরূপ জেলার বৃহত্তর নগরবেরা, সোনতলি এলাকার বলে তাঁদের কাছে খবর আছে বলে জানান বিধায়ক অশোককুমার সিংঘি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি মেঘালয়ের পূর্ব খাসিপাহাড়ের শেলা বিধানসভা এলাকার সোহরা (চেরাপুঞ্জি)-য় খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (কেএসইউ) এবং অউপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিকেল প্রায় চারটা নাগাদ প্রচণ্ড সংঘর্ষের পরিণতিতে এক জনজাতি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজ্য। ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওইদিন রাত দশটা থেকে দফায় দফায় রাজ্যের গৃহ দফতরের নির্দেশে পূর্ব খাসিপাহাড়ের জেলাশাসক এম ওয়ার নংব্রি শিলং-সহ গোটা জেলা এবং সোহরা মহকুমায় কারফিউ জারি করেছিলেন। ঘটনার পরেরদিন সকালে বড়বাজারে কয়েকটি ছুরিকাঘাত ও মারপিটের ঘটনা ঘটে। এতে এক অজনজাতি ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
ইস্ট খাসিপাহাড়ের পুলিশ সুপার ক্লাউডিয়া লিংগোয়ার কাছে জানা গিয়েছিল, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (সিএএ)-এর বিরোধিতা এবং ইনার লাইন পারমিট (আইএলপি) বলবতের দাবি প্ৰসঙ্গে ওইদিন বিকেল তিনটেয় ইস্ট খাসিপাহাড় জেলার অন্তর্গত শেলার সোহরা মহকুমার ইছামতি গ্রামে কেএসইউ এক সভার আয়োজন করেছিল। সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন কয়েকজন অজনজাতিভুক্ত যুবক (সন্দেহভাজন বাংলাদেশি)।
সভা শেষে অজনজাতি জনৈক ব্যক্তির বাড়িতে খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেয় সন্দেহভাজন কেএসইউ-এর সদস্যরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদ ক্রমে সংঘর্ষের রূপ নেয়। ওই সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশকর্মী এবং খাসি যুবক আহত হন। আহতদের নিয়ে ভরতি করা হয় সোহরা সিভিল হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে আহত লোকাল ট্যাক্সির ড্রাইভার জনৈক লুরসাই নিউতা (৩৫)-র মৃত্যু হয়। তার বাড়ি সোহরার একটি গ্রামে। গোটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে করে মেঘালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে হিংসা ছড়িয়েছে।