BRAKING NEWS

বাংলাদেশের বাজেটে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু বরাদ্দ ১২ টাকা, সংখ্যালঘুদের ৩ টাকা

ঢাকা, ২৩ জুন (হি.স.) : বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ রবিবার  এক সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় সংসদে পেশ করা আগামী বছরের (২০১৯-২০) বাজেটে ধর্ম মন্ত্রালয়ের সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে বলেছে, এই মন্ত্রকের বাজেট অনুযায়ী ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু বরাদ্দ  যেখানে ১১ থেকে ১২ টাকা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাথা পিছু বরাদ্দ সে ক্ষেত্রে মাত্র ৩ টাকা। যদিও সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিককে সমভাবে দেখতে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরিষদ প্রশ্ন তুলেছে, জনসংখ্যার ব্যাপক অংশ হিসেবে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় অবশ্যই মোট বরাদ্দের বৃহত্তর অংশ পাবে কিন্তু মাথাপিছু বরাদ্দের ক্ষেত্রে কেন বৈষম্য হবে ?


জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এদিন সকালে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত। এ সময় সংগঠনের সভাপতিমন্ড লীর সদস্য অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, বাসুদেব ধর, মিলন কুমার দত্ত, মঞ্জু ধর ও ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় উপস্থিত ছিলেন। 
ঐক্য পরিষদ প্রথমেই বলেছে, ধর্ম মন্ত্রকের অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে হজ নীতি, হজ প্যাকেজ ঘোষণা, দ্বি-পাক্ষিক হজ্ চুক্তি সম্পাদন, হজ্ যাত্রীদের আবাসন ব্যবস্থাপনাসহ হজ্ ও ওমরাহ গমন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি তীর্থভ্রমণ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়টিও উল্লেখিত রয়েছে। হজ বিষয়ক খাতে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৪৪.৩০ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৫৯.৩৯ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫৯.৭১ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬৭.২৫ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬৯.৭৫ কোটি অর্থাৎ এ পাঁচ বছরে মোট ৩০০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তীর্থভ্রমণের জন্যে অতীতের মতোই আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরেও কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। 


ঐক্য পরিষদ বলেছে, বাজেটে দেখা যায়, জেলা ও উপজেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৯১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩৬৮.৮৮ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৪৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা অর্থাৎ এ তিন অর্থ বছরে মোট ৮৯১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যে অনুরূপ মডেল মন্দির/প্যাগোডা/গীর্জা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে বাজেটে কোন বরাদ্দ নেই। কোনও কর্মসূচিও সরকারের নেই। 
পরিষদ বলেছে, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদ পরিচালনায় আগামি অর্থ বছর সহ গত পাঁচ অর্থ বছরের বাজেটে মোট ৪ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় উপাসনালয় সমূহকে প্রধান উপাসনালয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তা পরিচালনার জন্যে আগামী ২০১৯-২০ অর্থ বছরেও অতীতের মতো কোনরূপ বরাদ্দ রাখা হয়নি। 
ওয়াকফ ও দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন খাতে আগামি অর্থ বছর সহ পাঁচ বছরে মোট ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে পূর্বেকার মতোই এ বারের বাজেটেও কোন বরাদ্দ নেই। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য পাঁচ বছরে মোট ১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

অথচ  ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরোহিত, সেবায়েত এবং ধর্ম যাজকদের জন্য পূর্বের মতোই কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি খাতে পাঁচ বছরে বরাদ্দ হয়েছে ৯৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। হিন্দু পুরোহিত ও সেবায়েতদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে ২০১৫ সাল থেকে চলতি অর্থ বছর পর্যন্ত কিছু বরাদ্দ থাকলেও আগামী বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ইসলামিক মিশনের সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণা খাতে পাঁচ বছরে মোট ১২২ কোটি ১৮ লাখ টাকা বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক উন্নয়ন, গবেষণা পরিচালনার জন্যে কোনো বরাদ্দ নেই।
অবশ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যে মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণ শিক্ষা নামে বর্তমান সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যাতে  ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩৭ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫৪ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬২.৫৯ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণ শিক্ষা প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের। বিপরীতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা ইসলামিক মিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে কোন অমুসলিম নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্যে কিছু বরাদ্দ থাকলেও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্যে বাজেটে এ জাতীয় কোনও প্রকল্প বরাদ্দ নেই।


ঐক্য পরিষদ বলেছে, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাংলা ভাষাভাষী ও আদিবাসী জনগনের সম্মিলিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকার সর্বস্তরে ধর্মীয় বৈষম্যের যে সূচনা ঘটে সুদীর্ঘ চার দশক পরেও তা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় ।  
এ প্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কল্যাণে জাতীয় রাজস্ব বাজেট থেকে বার্ষিক বরাদ্দ প্রদান, বিদ্যমান হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট সমূহকে ‘ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তরিত করে বিরাজমান ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান এবং সকল ধর্মসম্প্রদায়ের জন্যে উন্নয়নের কার্যক্রমকে অধিকতর সম্প্রসারিত করা, বিগত চার দশকের অধিক অব্যাহত ধর্মীয় বৈষম্য নিরসনকল্পে আগামি অর্থ বছর ২০১৯-২০-এ দুই হাজার কোটি টাকা  বরাদ্দ করা হয়েছে, সরকারের ধর্ম মন্ত্রক কার্যতঃ সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে কাজ করছে তাই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রক এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল মন্দির/প্যাগোডা/গীর্জা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে আগামি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানিয়েছে। 


পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সারা দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বেড়ে যাওয়ার কথাও সাংবাদিকদের জানান এবং এ নিয়ে শিগগিরই পৃথক সাংবাদিক সম্মেলনে পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরার কথা বলেন। তিনি বলেন, যেহেতু ৩০ জুন বাজেট পাশ হয়ে যাবে, তাই বাজেটে বৈষম্যের বিষয়টি আগে তুলে ধরতে হল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *