ঢাকা, ১৩ জুন(হি.স.) : এ এক অন্য রকম নেশা। ক্রিকেট খেলার মাঠে না গিয়েই ব্যাট করা যায়। এর মাধ্যমে যেমন আয় হয় তেমনি সর্বস্ব হারাতেও হয়।এই ভয়ঙ্কর খেলার নাম অনলাইন জুয়া।এই জুয়া এখন বাংলাদেশে রমরমা। অবশ্য তা প্রতিরোধ করতে তৎপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।তবু থামছে না কিছুতেই।
জানা যায়, জুয়াড়িদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।অসংখ্য ওয়েবসাইট গড়ে উঠেছে জুয়া ভিত্তিক।যে কোনও খেলা নিয়েই জুয়া হচ্ছে এসব সাইটে।গত কয়েক মাসে অনলাইনে দেশে অন্তত শত কোটি টাকার জুয়া হয়েছে।চলতি মাসে এই সংখ্যা আরও বিপুল হবে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে বিপুল টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে অনলাইনে। জুয়া হচ্ছে বলে-বলে, চার, ছক্কাসহ রান নিয়ে। কোনও খেলোয়াড় কত রান করবেন, কত উইকেট নেবেন এসবের উপরও। অনলাইনের এই জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, চিকিৎসক, রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।খুব অল্প টাকায় জুয়া খেলার সুযোগ থাকলেও সাধারণত প্রতি জনে জুয়া হচ্ছে হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার।
কোনও কোনও আন্তর্জাতিক সাইটের এজেন্ট রয়েছে ঢাকায়। জুয়া খেলায় টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা নিজেরা সহযোগিতা করে।এক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিং বিকাশে টাকা লেনদেন করা হয়।এরকম দুটি সাইট থেকে গত তিন মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।সম্প্রতি অনলাইন বেটিং সাইট লিংক ব্যবহার করা অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম বিভাগ।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে উত্তর ধানমন্ডির নাজিদ রাব্বান জানান, দীর্ঘদিন থেকেই অনলাইনে জুয়া খেলায় অর্থ লেনদেনে তারা জড়িত। জুয়া খেলার একটি বিদেশী সাইটের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে তারা। অন্যের নামে নিবন্ধনকৃত বিকাশের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে অনলাইন জুয়াড়িদের টাকা লেনদেন করে তারা। খেলা চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত জুয়াড়িরা প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে নিজেদের নামে ডিপোজিট করে। ডিপোজিটের অর্থ দিয়ে জুয়াড়িরা জুয়া ধরে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে টাকাগুলো ডলারে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে অনলাইনে দেশীয় বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে। যেমন ঢাকা ক্লাব, সুইট অক্টাগন, স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড, বল বিডিসহ বিভিন্ন নামে জুয়াড়িদের ক্লাব রয়েছে অনলাইনে। এছাড়াও সেখানে যারা খেলেন তাদের অনেকেই ক্লাবের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে খেলায় অংশ নেন। বিকাশে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে মূলত ম্যাচ নিয়ে জুয়া হয়। বিকাশে লেনদেনের মাধ্যমে জুয়া খেলার ক্ষেত্রে কোনও সাইটে মধ্যস্বত্ত্বভোগী থাকেন। তাকে বলা হয় পেটিসখোর। পেটিসখোরের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বাজি নেওয়া। দুই বা তার অধিক পক্ষের বা গ্রুপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী ব্যক্তিকে তা বুঝিয়ে দেন পেটিসখোর। এক্ষেত্রে পেটিসখোর পান ৫ থেকে ১০ শতাংশ টাকা।
অনলাইনে ক্রিকেট ছাড়াও বেটিং সাইট লিংক ব্যবহার করে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল টুর্নামেন্টসহ বিশ্বের জনপ্রিয় যে কোন খেলাধুলা নিয়ে জুয়া হচ্ছে। পরিচিত একটি সাইটের জুয়াখেলা সম্পর্কে জুয়াড়িরা জানান, এতে নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদির সঠিক তথ্য দিয়েই অ্যাকাউন্ট করতে হয়। এমনকি অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করার জন্য পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ড্রাইভিং লাইন্সেস এবং ব্যাংক স্টেটমেন্টের ছবি তুলে সাবমিট করতে হয়। ২০ টাকা জমা করেই এতে বেট করা যায়। অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রয়োজন হয় পাঁচশো টাকা। সাধারণত জুয়ার টাকা পেমেন্ট করা হয় নিটেলার ও স্ক্রল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এছাড়াও ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন অনেকে। টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে নিটেলার ও স্ক্রল অ্যাকাউন্টের ব্যবহারই বেশি বলে জানান জুয়াড়িরা। অ্যাকাউন্ট লগইন করে পছন্দ মত খেলাটি বেছে নেন। তারপর কোন দলের পক্ষে, কিসের উপর বেট করবেন তা সিলেক্ট করতে হয়। সেইসঙ্গে ডলার বা সেন্টের পরিমাণও সিলেক্ট করে ক্লিক করতে হয়।
অতঃপর হারলে টাকা কেটে নেবে আর জিতলে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে।শখে এবং পরিশ্রম ছাড়া বসে বসে অর্থ আয় করতে গিয়ে এতে নেশাগ্রস্ত হচ্ছেন তরুণরা। লাভ হলে বাজি ধরা ডলারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আর হারলে যা ধরলেন তা। এই লোভে এই খেলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকে। জুয়া খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে একজন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট (ইউল্যাব)’র আইন বিভাগের ছাত্র। হাজার-হাজার টাকা জুয়া খেলে বেশ ভালোই আয় করছিলেন তিনি। এতেই অনলাইন জুয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। বেশ কিছুদিন আগে নিজের কাছে থাকা প্রায় ৪৫ হাজার টাকা নিয়ে জুয়া খেলে আয় করেন দেড় লক্ষাধিক টাকা। নিজের কাছে থাকা টাকা ও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে দুই লাখ টাকা নিয়ে জুয়ায় নামেন তিনি। তারপরই ধাক্কা খান। সর্বস্ব হারান। ঋণ শোধ করতে পারেন না। এ নিয়ে মারধরের শিকার হন এই শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে নিজের ফোন, ল্যাপটপ বিক্রি করে ও বাবার কাছ থেকে টাকা এনে সেই ঋণ শোধ করেন তিনি। একইভাবে রংপুরের বদরগঞ্জে জুয়া খেলে নিজেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন এক যুবক। প্রথমে টাকা আয় করেছেন ভালোই। এতে বেশি টাকা আয়ের জন্য স্ত্রীকে চাপ দেন। যৌতুক চান। গবাদি পশু বিক্রি করে টাকা দেন শ্বশুর। সেই টাকা দিয়ে জুয়া খেলেন। একপর্যায়ে সর্বস্ব চলে যায়। আবার স্ত্রীকে টাকার জন্য চাপ দেন। মারধর করেন। এ নিয়ে বদরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ গণমান্যদের নিয়ে সালিস বৈঠক হয়। সর্বশেষ স্ত্রীর দায়েরকৃত নির্যাতনের মামলায় জেল খাটতে হয় এই জুয়াড়িকে। এভাবেই অনলাইন জুয়ায় সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই।
এসব বিষয়ে সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, আমাদের পরামর্শে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) অনেকগুলো সাইট বন্ধ করেছে। তারপরও জুয়াড়িরার নতুন নতুন বিভিন্ন সাইট ও প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে জুয়া খেলছে। বিষয়টি আমরা নজরদারি করছি। এতে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।