রোজভ্যালীর বিরূদ্ধে সিবিআই চেয়ে ফের কেন্দ্রে চিঠি রাজ্যের

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৯ জুন৷৷ রোজভ্যালী কেলেঙ্কারীর সিবিআই তদন্তের জন্য অনুরোধ জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে রাজ্য সরকার৷ চিঠিতে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সার্ভিস তথা চিটফান্ডের অন্যান্য মামলাগুলির চাইতে রোজভ্যালীর মামলার তদন্ত যাতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়৷ রোজভ্যালীর তিনটি পৃথক মামলায় মোট ৯৮ কোটি ১৬ লক্ষ ৭৯ হাজার ৬৮৫ টাকা তছরূপ হয়েছে বলে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় জন অভিযোগ এবং পেনশন মন্ত্রকের সচিবকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়৷ গত ২২ মে এই চিঠি দিল্লীতে পাঠানো হয়েছে৷ চিঠির কপি সিবিআইয়ের নয়াদিল্লীস্থিত অফিসের অধিকর্তা এবং গুয়াহাটিস্থিত সিবিআইয়ের পূর্বোত্তর জোন অফিসের যুগ্ম অধিকর্তাকে পাঠানো হয়েছে৷


রাজ্যে জোট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম এজেন্ডা ছিল রোজভ্যালী কেলেঙ্কারীর সিবিআই তদন্ত করানো৷ বিজেপির ভিশন ডকুমেন্টেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বিজেপি ক্ষমতায় আসলে রাজ্যে সিবিআই সহ অন্যান্য চিটফান্ড সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারীর সিবিআই তদন্ত করা হবে৷ যদিও নির্বাচনের আগে সিবিআই রাজ্যে এসেছিল চিটফান্ড সংস্থার আর্থিক ঘোটালার তদন্ত করতে৷ কয়েক দফায় এখানে এসে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভার একজন মহিলা মন্ত্রী সহ সিপিএমের প্রভাবশালী এক নেতৃত্বকে জেরা করেছিল৷ তারপর সিবিআই আর তেমন কোন তৎপরতা দেখায়নি৷ এরপর বিধানসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং বিজেপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসে৷ ক্ষমতায় আরোহণের প্রায় সতের মাস পর বিজেপি জোট সরকার রোজভ্যালীর আর্থিক ঘোটালার সিবিআই তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি দিল৷
রাজ্য সরকারের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চিটফান্ড তথা এনবিএফসির ৭৪ মামলা ছাড়াও রাজ্যে রোজভ্যালীর বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল৷ এই তিনটি মামলা হচ্ছে পশ্চিম আগরতলা থানায় মামলার নম্বর ১৩২/২০১৩, কুমারঘাট থানায় মামলার নম্বর ৫৭/২০১৫ এবং বীরগঞ্জ থানায় মামলার নম্বর ২৯/২০১৫৷ এই তিনটি মামলায় রোজভ্যালী মোট ৯৮ কোটি ১৬ লক্ষ ৭৯ হাজার ৬৮৫ টাকা তছরূপ করেছে৷ তাই, চিটফান্ডের যে ৭৪টি মামলা সিবিআইয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে তদন্তের জন্য সেই সাথে রোজভ্যালী কেলেঙ্কারীর উক্ত তিনটি মামলাও যাতে সিবিআই গ্রহণ করে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তদন্ত করে৷ রাজ্য সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি অরূপ দেব গত ২২ মে কেন্দ্রীয় সরকারের জন অভিযোগ এবং পেনশন মন্ত্রকের সচিবকে চিঠিটি দিয়েছেন৷


চিটফান্ড কেলেঙ্কারী নিয়ে কংগ্রেস আন্দোলনমুখী হয়েছিল৷ সিবিআই তদন্তের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ আমানতাকারীদের কষ্টার্জিত আমানত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবী জানানো হয়েছিল৷ এই দাবী নিয়ে কংগ্রেস ওইসময় দিল্লীতে ধর্ণাও দিয়েছিল৷ তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্যোগ নিয়েছিল৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়ায় তারা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করে দাবী সনদ পেশ করেছিলেন৷ তখন কংগ্রেসে ছিলেন বর্তমানের বিজেপি বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন৷ সুদীপ রায় বর্মন সহ রাজ্য কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্ব দিল্লীতে ধর্ণা দিয়েছিলেন৷ রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন৷ এমনকি রাজ্যে তখন কংগ্রেসের তরফ থেকে একটি সেল খোলা হয়েছিল চিটফান্ডের কেলেংকারীতে ক্ষতিগ্রস্থ আমানতকারীদের কাছ থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করার এবং সেই নথিপত্রের ভিত্তিতে কংগ্রেসের আইনজীবী সেল আদালতের দ্বারস্থ হবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল৷ মোটের উপর রোজভ্যালী সহ অন্যান্য চিটফান্ড সংস্থার প্রতারণার শিকার হওয়া আমনাতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কংগ্রেস আইনী লড়াইয়ের পথে হেটেছিল৷ কিন্তু, বেশীদূর এগুতে পারেনি৷ রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়৷ গণহারে নেতা নেত্রীরা দলবদল করেছেন৷ তাতে চিটফান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ আমানতাকীরদের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে গেল৷


এদিকে, বাম জমানায় চিটফান্ড সংস্থাগুলির রমরমা বাণিজ্য ছিল৷ রোজভ্যালীর সাম্রাজ্যের বিস্তার হয় গোটা রাজ্যের আনাচে কানাচে৷ একশ্রেণীর এজেন্ট সিপিএম ক্যাডার রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান৷ রোজভ্যালীর প্রতারণার ফাঁদ ক্রমশ বড় হতে থাকে৷ আর এই প্রতারক সংস্থার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সময়ে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী ও বিধায়ক উল্লেখযোগ্য ভূূমিকা রেখেছিলেন৷ আর তাতে করেই প্রতিশ্রুতির ডালি নিয়ে এরাজ্যে শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে রোজভ্যালী৷ কোথাও হোটেল, কোথাও চা বাগিচা, জলের কারখানা, সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসা শুরু করে৷ আমতলীতে বিনোদন পার্ক পর্যন্ত খোলা হয়৷ আর এই পার্ক খোলার জন্য জমি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের তরফ থেকেই দেওয়া হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত রোজভ্যালীর প্রতারণা প্রকাশ্যে আসে৷ আমনতকারীরা পথে নামে৷ বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনের কুম্ভনিদ্রা ভঙ্গ হয়৷ শুরু হয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রক্রিয়া৷ গণহারে ধরপাকর৷ বিভিন্ন সম্পত্তি আদালতের নির্দেশে দখল নেওয়া ইত্যাদি৷ রোজভ্যালীর রাঘাববোয়ালরা রাজ্যান্তরি হয়ে যায়৷


বিরোধীদের চাপের মুখে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বিধানসভায় চিটফান্ড সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী আনে৷ বিভিন্ন মামলা সিবিআই তদন্তের জন্য পাঠাতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু, তাতেও অভিযোগ উঠেছিল রোজভ্যালী সংক্রান্ত মামলাটির আর্থিক তছরূপের অংক মাত্র ৪৫ হাজার টাকা দেখানো হয়৷ এই অল্প পরিমান টাকার বিষয়টি মামলার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়৷ সিবিআই মামলাটি নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে৷ তারপর এই নিয়ে কমজল ঘোলা হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার পালাবাদল হয়৷ বিজেপি জোট সরকার রাজ্যে সরকার গঠন করে এবং এখন পুনরায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি পাঠানো হয় যাতে রোজভ্যালীর আর্থিক কেলেঙ্কারীর তিনটি মামলা যাতে সিবিআই গ্রহণ করে৷