BRAKING NEWS

সমুদ্র সৈকত ও প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন – ভ্রমণে পুরী

অপর্ণা সাহা

প্রতিদিনের রুটিন থেকে বেড়িয়ে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগ আমরা সবাই চাই। আর শুধু প্রকৃতি নয়, প্রাগৈতিহাসিক কালের অনেক পুরাকীর্তি, স্থাপত্য ও নিদর্শন আছে আমাদের পৃথিবীতে। কত জানা অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ আমাদের এই পৃথিবী। সেগুলো জানা আর নিজের ভ্রমন পিপাসা মেটানোর সুযোগের অপেক্ষায় আমরা সবাই কমবেশি থাকি। আমরা বাঙ্গালীরাও এর বাতিক্রম নই।

ভারত বর্ষের ২৯ টি প্রদেশের মধ্যে ওড়িশা অন্যতম। বঙ্গোপসাগরের পাশে অবস্থিত এই রাষ্ট্র বিবিধ হিন্দু মন্দির ও উপজাতীয় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এর রাজধানী ভুবনেশ্বরকে একশত মন্দিরের বাড়ী বলা হয়। পুরী, ওড়িশার একটি শহর। বহু বাঙালি ও দেশ-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা এখানে। সমুদ্র সৈকত হল পুরীর প্রধান আকর্ষণ। বঙ্গোপসাগরের তীরে এই সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার ইচ্ছে যে কোন বাঙ্গালীর হৃদয়ে বিদ্যমান। ভারতীয় ভ্রমন মন্ত্রানালয়, ভারতীয় হস্তশিল্প কমিশনার ও পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দ্বারা প্রতি বছর বাৎসরিক ‘পুরী বীচ ফেস্টিভ্যাল’ পরিচালিত হয়। পুরী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ২ কিলো মিটার দূরে এই সমুদ্র সৈকত। বীচের পাশে ও এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেক হোটেল যেখানে থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে।

সমুদ্র সৈকত কে না ভালবাসে? কত দূর থেকে ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায়। কিছু কিছু হোটেল আছে সৈকতের খুব কাছে। জানালা দিয়েই সমুদ্র দেখা যায়। দূর থেকে মনে হয় যেন দুধ সাদা ফেনার মতন। উঁচু উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রের তীরে দাঁড়ানো মানুষ গুলোর কেউ শুধু পা ভেজাচ্ছে, কেউ স্নান করছে , কেউ আবার দূরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে আর হরেক রকম মিষ্টির স্বাদ আস্বাদন করছে। মিষ্টি ছাড়াও শামুক, ঝিনুকের অনেক জিনিস বিক্রি হয় পুরীর সৈকতে। ছোট ছোট দোকান বসে বীচে। দেব দেবীর ছবি, পুজার সামগ্রী, শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি হাতের কাজের সামগ্রী ও ধর্মীয় গ্রন্থ পাওয়া যায় এসব দোকানে। পুরীর বীচ ঘোরার পর হাতে সময় থাকলে উদয়গিরি, খাণ্ডাগিরি ও কোনারক সূর্য মন্দির এই তিনটি তাৎপর্য পূর্ণ স্থানে অবশ্যই যাওয়া উচিত।

ভুবনেশ্বরের কাছে অবস্থিত উদয়গিরি ও খাণ্ডাগিরি হল গুহা যা আগে কট্টক গুহা নামে পরিচিত ছিল। এটা আংশিক প্রাকৃতিক ও আংশিক কৃত্রিমভাবে নির্মিত স্থাপত্য যা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরত্ব বহন করে। পুরী থেকে ‘ওড়িশা ট্যুরিজ্‌ম’ এর বাস ছাড়ে। প্রতিটি বাসে একজন করে গাইড থাকেন যারা উদয়গিরি, খাণ্ডাগিরি ও কোনারক সূর্য মন্দির ঘুড়িয়ে দেখায়।

উদয়গিরি অর্থ ‘সূর্যোদয় পাহাড়’। উদয়গিরি-খাণ্ডাগিরি এই গুহা দুটো পাশাপাশি মিলিত পাহাড়ে অবস্থিত যেটা কুমারী পর্বত নামে ও পরিচিত। খুব সূক্ষ্ম ও সুনিপুন ভাবে তৈরি এই গুহা ২০০ খ্রিস্টপূর্বে নির্মিত। আঠারোটি গুহার সমন্বয় উদয়গিরি পর্বত এবং পনেরটি গুহা আছে খাণ্ডা গিরিতে। কালিঙ্গাধিপতি এর শাসনামলে নির্মিত উদয়গিরি-খাণ্ডাগিরি। উদয়গিরির গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হল একটি দ্বিতল ঘর, রানিগুম্ফ। এছাড়া রয়েছে হাতি গুম্ফ, অনন্ত গুম্ফ, গনেশ গুম্ফ, জয়-বিজয় গুম্ফ ও আরও অনেক গুম্ফ। গুম্ফ গুলো সাধারণত সন্ন্যাসীদের বাসস্থান বলে ধারণা করা হয়। সবসময় পর্যটকদের ভীর লেগেই থাকে এই স্থানে।

উদয়গিরি, খাণ্ডা গিরির পর যে স্থানটি পর্যটকেরা যান সেটা হল কোনারক সূর্য মন্দির, যে মন্দির দেখতে দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটকরা ছুটে আসে পুরীতে। তেরো শতকে নির্মিত এই মন্দিরটি রাজা নরসিংহ দেব তৈরি করেছিলেন যা ভারতের সপ্তম আশ্চর্যের একটি নিদর্শন। সূর্য দেব কে উৎসর্গ করে এটি নির্মিত হয়। সংস্কৃত শব্দ কোণ অর্থ কোণা এবং অর্ক অর্থ সূর্য থেকে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। মন্দিরটির অবয়ব সূর্য দেবের রথের মতন করে তৈরি করা। ভারী পাথরে খোদাই করা বিশাল এই রথ সাত টি ঘোড়া বারো জোড়া চাকার উপর টানছে। খোদাই করা সবচেয়ে বড় চাকাটি এতটাই অপূর্ব যা দেখলে ঐ সময়কার নিখুদ নির্মাণ শৈলীর পরিচয় মেলে।

প্রভু জগন্নাথ দেবের মন্দির পুরীতে অবস্থিত। প্রতি বছর রথ যাত্রার জন্য এই মন্দির বিখ্যাত। বহু অগণিত মানুষের ঢল নামে তখন পুরীতে। আশে পাশের সব হোটেল দর্শনার্থীদের ভীরে উপচেয়ে পরে। খুব জাগ্রত পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির। অন্যান্য মন্দির এর বিগ্রহ আমরা সাধারণত পাথরের অথবা ধাতু দিয়ে তৈরি দেখতে পাই। কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহ কাঠ দ্বারা নির্মিত এবং প্রতি আট, বারো অথবা উনিশ বছর পর পর বিশেষ ক্ষণে এটি পরিবর্তিত হয়। পুরাতন বিগ্রহের বদলে নব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা কে ‘নবকলেবর’ বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৬ সালের পর ২০১৫ সালে নবকলেবর শেষ বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চন্দ্র বছর ও সৌর বছর হিসেব করে একটি দিন নির্বাচিত হয়। সেই বছর আষাঢ় মাসে দুবার পূর্ণিমা হবে। চৈত্র শুক্ল দশমীতে পুরহিত, সাধু ও সন্ন্যাসীদের একটি দল বিশেষ ধরনের নিম গাছ বিশেষ স্থানে সন্ধান করে যার গায়ে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মের প্রতীক অবশ্যই থাকবে। এই নিম গাছ কে ‘দারু ব্রহ্ম’ বলা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র সেই নিম কাঠ দ্বারাই জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা ও সুদর্শন এই চার বিগ্রহ তৈরি করা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল মানুষের জন্য উৎসর্গিত এই মন্দির। এই মন্দিরের সাথে জড়িত ছিলেন রামানন্দ ও রামানুজার মত সন্ন্যাসীরা। কথিত আছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তার জীবনের শেষ কুড়ি বছর পুরীতে প্রভু জগন্নাথ দেবের আরধনায় কাটিয়েছেন। ২০১৫ সালের নব কলেবরে প্রায় তিন লক্ষ ভক্তের ঢল নামে পুরীতে।

রাজা অনন্ত বর্মণ এর শাসনামলে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এই মন্দিরের আর তার ছেলের শাসনামলে এর কাজ শেষ হয়। এরপর বংশ পরম্পরা ক্রমে এই মন্দিরের উন্নয়ন চলতে থাকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিন মূর্তির পুজা হয় এই মন্দিরে। প্রতিদিন সকালে সাত রকম খাবার দিয়ে বাল্য ভোগের আয়োজন করা হয়। এরপর সকাল ১০ টায় তেরো রকমের ভোগ দেয়া হয়। একইভাবে দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয় আর রাত আট টায় সন্ধ্যা আরতির পর রাতের খাবার নিবেদন করা হয়। প্রভু জগন্নাথ কে নিবেদন করা ভোগ প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। জগন্নাথ ধাম পুরী হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য এক মহাপুন্যভুমি হিসেবে পৃথিবী খ্যাত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরী কে জ্ঞ্যান এর সাগর বলে আখ্যা দিয়েছিলেন যেখানে মানুষ নিজেদের জানার ইচ্ছে চরিতার্থ করতে পারে। আমিও সেই কথার রেশ ধরেই পুরী তে ভ্রমন উৎসাহী মানুষদের স্বাগত জানাই যেখানে তারা নিজেদের চর্ম চক্ষু সার্থক করার সুযোগ পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *