গোরক্ষপুরে প্রশাসনিক টানাপোড়েনের মধ্যে বেড়েই চলেছে মৃতের সংখ্যা, সরব সব মহল

লখনউ, ১২ আগস্ট (হি.স.) : প্রশাসনের টানাপোড়েনের মধ্যেই ক্রমশ বেড়েই চলেছে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের বাবা রাঘব দাস মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত শিশুর সংখ্যা | শনিবার শেষ খবর, এপর্যন্ত মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে | এর মধ্যে ৩৬ জন শিশু| হাসপাতালে এখনও অনেক শিশু গুরুতর অসুস্থ। আরও বাড়তে পারে মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ ও অক্সিজেনের অভাবে সবকটি মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থনাথ সিং সহ দুই মন্ত্রীকে শহর পরিদর্শন করে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন।
হাসপাতাল ও সরকারের দাবি, অক্সিজেন সরবরাহ কম থাকার কোনও ঘটনা ঘটেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই সংস্থাটি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করলেও অন্য দুটি সংস্থা সময়মত অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। যে সংস্থা হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে ছিল, সেই এইচআর পুষ্পা গ্যাস এজেন্সিরও দাবি, তারা অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করেনি, এভাবে আচমকা সরবরাহ বন্ধ করা যায় না, এর ফল কী হতে পারে তারা জানে। তবে ওই সংস্থায় সকাল থেকে তল্লাশি চলছে। সংস্থার মালিক মণীশ ভাণ্ডারি গা ঢাকা দিয়েছেন।
সরকারের তরফে গত ২৪ ঘণ্টায় একাধিক বার বিবৃতি জারি করে দাবি জানানো হয়েছে অক্সিজেনের কোনও ঘাটতি ছিল না হাসপাতালে। গাফিলতির অভিযোগ না মানলেও যোগী সরকার ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থনাথ সিং এবং প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত মন্ত্রী আশুতোষ ট্যান্ডন সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সিদ্ধার্থনাথের দাবি, ৭ তারিখ থেকেই ওই হাসপাতালে নানা রোগে ৬০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে, সব মৃত্যুর কারণ অক্সিজেনের অভাব নয়। তাঁর আরও দাবি, হাসপাতালে যে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব রয়েছে, সে ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীকে আদৌ জানানোই হয়নি, জানতেন না চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত মন্ত্রীও।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডাও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অনুপ্রিয়া প্যাটেলকে নির্দেশ দিয়েছেন গোরক্ষপুরে যেতে। উপ মুখ্যমন্ত্রী কেশবপ্রসাদ মৌর্য বলেছেন, এই ঘটনায় যেই অপরাধী হোক, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোটা ঘটনার বিশদ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, শিশু মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে তারা তদন্ত করছে।
এই ঘটনায় সরব হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সমাজকর্মী সকলেই| শিশুমৃত্যুর ঘটনায় বিরোধীরা একযোগে তুলোধোনা করেছে রাজ্য সরকারকে। কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল হাসপাতালে গিয়েছে, দলে রয়েছেন গুলাম নবি আজাদ ও রাজ বব্বর। স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত মন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে তারা। বিএসপি মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের পদত্যাগ দাবি করেছে। বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ এই ঘটনায় কাঠগড়ায় তুলেছেন যোগী সরকারকে। এভাবে শিশুমৃত্যু নরসংহার বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। শোক প্রকাশ করেছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী ।
এক ট্যুইট বার্তায় শিশুমৃত্যুতে শোকাহত সত্যার্থী বলেছেন এটা কোন নিছক ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক ঘটনা নয় । এটা একটা হত্যাকান্ড । আমাদের শিশুদের জন্য স্বাধীনতার ৭০ বছরের মর্মার্থ কি এটাই । সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বছপন বাঁচাও আন্দোলনের এই সমাজকর্মী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতি রুখতে মুখ্যমন্ত্রী সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত । যাতে করে এই ঘটনাগুলোকে ভবিষ্যতে রোখা যায় ।
এদিকে, এই ঘটনায় বিরোধী নেতা রামগোবিন্দ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় | এদিন বিধান সভায় সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব এই ঘটনার পূর্নাঙ্গ তদন্তের দাবি তোলেন | এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী নেতা রামগোবিন্দ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় | এই ছয় সদস্যের মধ্যে রয়েছে, প্রাক্তন মন্ত্রী ব্রহ্মশঙ্কর ত্রিপাঠি, সন্তোষ যাদব, এমএলসি রাধেশ্যাম সিং, প্রাক্তন রাজ্যের মন্ত্রী প্রহ্ল্লাদ যাদব, সপার জেলা সভাপতি জিয়াউল ইসলাম, এবং সপার মহানগর সভাপতি | জানা গেছে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ইতি মধ্যেই ঘটনা স্থলে রওনা দিয়েছে | রবিবার এই তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেবে | এ ঘটনায় ইতি মধ্যেই হাসপাতাল সুপারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে|
অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে থাকা সংস্থা পুষ্পা সেলসকে বকেয়া ৫১ লাখ টাকা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও তাদের সরবরাহ ঠিকমত না হওয়ায় যোগাযোগ করা হয়েছে আরও দুটি সংস্থার সঙ্গে। আজ সকালেই ওই ওয়ার্ডের জন্য এসে যায় ৫০টি সিলিন্ডার। দুপুরেও আরও ৫০টি সিলিন্ডার আনা হয়েছে। প্রসঙ্গত এনসেফ্যালাইটিসের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে এক একবার ১৬টি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগে, যা দেড় ঘণ্টা করে চলে।
জানা গিয়েছে, পুষ্পা সেলস ওই হাসপাতালের কাছে ৬৬ লক্ষ টাকা পেত। চুক্তি অনুযায়ী মেডিক্যাল কলেজের বকেয়া যতক্ষণ ১০ লাখ পর্যন্ত থাকছে, ততক্ষণ অক্সিজেন সরবরাহ বজায় থাকার কথা। পয়লা অগাস্টই ওই সংস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয়, টাকা না মেটালে তারাও আর অক্সিজেন জোগাড় করতে পারবে না।
হাসপাতাল কর্মীরা অক্সিজেনের অভাবের কথা জানিয়ে ১০ তারিখই চিঠি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় পাইপ লাইন কর্তৃপক্ষকে। চিঠিতে কর্মীরা অক্সিজেন সরবরাহ কম থাকার কথা উল্লেখ করে জানায় বাচ্চাদের জীবন সংশয় হবে। তারপরেও হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।এরপর ১০ তারিখ সন্ধেয় ওই হাসপাতালে অক্সিজেন সরবহার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সে রাতেই শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ ছোঁয়, সব মিলিয়ে মারা যান ৩৬ টি শিশু সহ ৬৩ জন।