নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৭ অক্টোবর৷৷ দেশাত্মবোধের প্রশ্ণে দল যখন সমালোচিত, তখন দেশের স্বাধীনতা নিয়ে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বদের অবস্থান স্পষ্ট করার তাগিদ বেড়েছে৷ দলের রাজ্য সম্পাদকের পর এবার সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার আজ দাবি করেন, দেশ স্বাধীন হলেও, আক্ষরিক অর্থে দেশবাসীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হয়নি৷ তিনি সওয়াল করেন দেশভাগের প্রসঙ্গ নিয়েও৷ তাতে স্বাধীনতার প্রশ্ণে সিপিএম’র অবস্থান যে এখনো একই জায়গায় তাই আজ স্পষ্ট হয়ে গেল৷ এছাড়া, ব্রিকস সামিটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ নিয়ে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে যেভাবে সুর চড়িয়েছেন, তার বদলে চিনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরেছেন সেটাই গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ ছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার মনে করেন৷ সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরোধীতায় না গিয়ে নতুন করে সমালোচনা এড়ানোর চেষ্টা করেছেন ঠিকই, কিন্তু এবিষয়ে তিনি যে সন্তুষ্ট নন তা এদিন তাঁর বক্তব্যে অনেকটাই স্পষ্ট৷

সিপিএম’র ৯৭ তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার আগরতলায় টাউন হলে এক হল সভা আয়োজিত হয়৷ তাতে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার দেশের স্বাধীনতা নিয়ে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হে, ভুলো মত, ভুলো মত’ দলের এই অভিমত প্রসঙ্গে অবস্থান স্পষ্ট করতে চান৷ তাঁর বক্তব্য, দেশ স্বাধীন হলেও, আক্ষরিক অর্থে দেশবাসীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ হয়নি৷ অবশ্য তিনি একথাও মেনে নিয়েছেন দল সেদিন ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিল স্বাধীনতা নিয়ে তাদের অবস্থান সঠিক ছিল না৷ কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষের স্বার্থ রক্ষা হয়নি সে কথা আজ তিনি দৃঢ়তার সাথে জানান৷ তাঁর মতে, স্বাধীনতা পঁুজিপতিদের স্বার্থে হয়েছিল৷ এজন্য আজও তিনি মনে করেন, দেশবাসীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ হয়নি৷ দেশভাগ প্রসঙ্গেও সওয়াল করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি এদিন তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, দেশভাগের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তার স্বার্থকতা নেই৷ এদিন তিনি বলেন, দেশভাগ মহাত্মা গান্ধীও মেনে নিতে পারেননি৷
অবশ্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ণে আজকের পরিস্থিতিকে মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷ তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেমন একচেটিয়া পঁুজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছিল, আজও সেই পথই অনুসরণ হচ্ছে৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আজও দেশে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষের স্বার্থ ভুলুন্ঠিত৷ কেবলমাত্র পঁুজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করা হচ্ছে৷
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে এদিন তিনি ব্রিক্স সামিটে ভারত এবং চীনের বক্তব্য টেনে আনেন৷ তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে সুর চড়িয়েছেন, তার বদলে চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেটাই ভারত সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল৷ মুখ্যমন্ত্রীর মতে, দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, কৃষক আত্মহত্যা করছে, মানুষ ক্ষুধার্ত সেক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির বিষয়ে ব্রিক্স সামিটে উদ্বেগ প্রকাশ করাই উচিত ছিল৷ তবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে যে বক্তব্য রেখেছেন তার সরাসরি বিরোধীতায় না গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এদিন নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেননি৷ কিন্তু ব্রিক্স সামিটে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্রী সন্তুষ্ট নন সেকথাও অনেকটা স্পষ্ট৷ তিনি বলেন, ব্রিক্স সামিটে কেবল সন্ত্রাসবাদ নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত সরকার৷ সেটা একান্তই ভারত সরকারের বিষয়৷ সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে তিনি চান না৷ তাতে স্পষ্ট যে, চীন যেভাবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত সরকারও সে বিষয় নিয়েই আলোচনা করলে তিনি খুশী হতেন৷
এদিকে, সারা দেশে সব দলের কাছেই সিপিএম প্রধান শত্রু বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এবিষয়ে তার যুক্তি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরলস আন্দোলনের কারণেই অতীতে কংগ্রেস এবং এখন বিজেপির প্রধান শত্রু সিপিএম৷ তাঁর মতে, শ্রেণীগত দিক দিয়ে কংগ্রেসের সাথে বিজেপির কোন ফারাক নেই৷ দক্ষিণপন্থার দিকেই তাদের ঝোঁক বলে মুখ্যমন্ত্রী এদিন সমালোচনা করেন৷ তিনি বলেন, কংগ্রেস ও বিজেপি প্রত্যেকেই ধনীদের স্বার্থের অনুসারী৷ তবে, কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপি আরো বিপজ্জনক৷ কারণ, তারা প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতাকে মদত দিচ্ছে৷ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন করতে চাইছে৷ মোট কথা এক দলীয় স্বৈর শাসন কায়েম করার চেষ্টা চলছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন৷ তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের ওপর ক্রমাগত বোঝা চাপছে৷ একমাসে চারবার পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েছে৷ সংখ্যালঘুরা এখন বিজেপির চালিকা শক্তি আরএসএস’র সংখ্যাগুরুদের দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত৷ এজন্য সিপিএমকেই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ সেক্ষেত্রে দলকে আরো শক্তিশালী করতে হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী এদিন দলীয় নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সংগঠনের শক্তি বাড়াতে মানুষের মাঝে যেতে হবে৷ তাঁদের কথা শুনতে হবে এবং তাঁদের সাথে থাকতে হবে৷ কেবল নেতাদের পেছনে পেছনে না ঘুরে কাজের কাজ করে দেখাতে হবে৷ তিনি অনেকটা উদ্বেগের সুরে বলেন, রাজ্যে এখনো প্রচুর মানুষ অসংগঠিত হয়ে আছে৷ তাঁরা এখনো আমাদের মঞ্চে আসেননি৷ তিনি দাবি করে বলেন, তাঁরা ভুল শিবিরে রয়েছেন এবং ভুল পথে চলছেন৷ এজন্য তাদের সিপিএম’র সাথে সংগঠিত করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দেন৷ এরই পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকেও দলে আনার বিষয়ে জোর দেন৷