ইউসুফ কমিশনের ১৫৯ পাতার রিপোর্টে বিস্ফোরক তথ্য, জঙ্গী-বিমল গোপন সম্পর্ক ফাঁস

BIMAL SINHAনিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৩ মার্চ৷৷ উগ্রপন্থীদের সাথে রাজ্যের প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল বলে ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে৷ বুধবার রাজ্য বিধানসভায় ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়৷ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হাইকোর্ট অব ত্রিপুরা রাজ্য সরকারকে ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে এম ইউসুফকে মন্ত্রী বিমল সিনহা ও তাঁর ভাই বিদ্যুৎ সিনহার জঙ্গী কর্তৃক হত্যাকান্ডের তদন্তে কমিশন হিসেবে নিযুক্ত করে রাজ্য সরকার৷ রাজ্য সরকার ৬ জুন, ১৯৯৮ এক নোটিফিকেশন মূলে বিচারপতি কে এম ইউসুফকে তদন্ত কমিশনের দায়িত্ব দেয়৷ ১৯৯৮ সালের ৩১ মার্চ ধলাই জেলার ধলাই নদীর পাড়ে আভাঙ্গায় উগ্রপন্থীদের গুলিতে বিমল সিনহা ও তাঁর ভাই বিদ্যুৎ সিনহা নিহত হন৷ কমিশনের এই রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করা হয় ২০০০ সালে৷ রাজ্য সরকার এই রিপোর্ট হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ হাইকোর্টের নির্দেশে এই রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজ্যে সংগঠিত উগ্রপন্থী কার্য্যকলাপের বিষয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে৷
ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তথ্য এবং ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার সাথে জঙ্গীদের যোগাযোগ ছিল৷ তাঁর ভাই বিক্রম সিনহা জঙ্গীদের দ্বারা অপহৃত হওয়ায় তিনি মানসিক ভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন৷ বিক্রম সিনহাকে জঙ্গী কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷ কমিশনের কাছে কমলপুরের সিপিএমের সক্রিয় নেতৃত্ব রঞ্জিত ঘোষ যে তথ্য দিয়েছে তা উল্লেখ করে কমিশন জানিয়েছে বিমল সিনহা রঞ্জিত ঘোষকে জানিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর ভাইকে জঙ্গী কবল থেকে মুক্ত করতে হিমাংশু দাস, সুধাংশু দাস, সত্য দাস এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করতে৷ কমিশনের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সিপিএম দলের যেকোন নেতা কর্মী জঙ্গী কর্তৃক অপহৃত হলে তাকে মুক্ত করতে সহায়তা করেন৷ এইসব ক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন বহুবার৷ এমনকি এই হত্যাকান্ডের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী তথা কমলপুরের সিপিএম নেতা রঞ্জিত ঘোষের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে৷ তিনিও জঙ্গী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন৷ তাকে অক্ষত অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিমল সিনহার হস্তক্ষেপ ছিল৷ রঞ্জিত ঘোষ পরিস্কার ভাষায় জানান যে, বিমল সিনহা জঙ্গীদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন বিভিন্ন রফাদফা করার জন্য৷ এদিকে, ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার স্ত্রী বিজয় লক্ষ্মী সিনহা জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী বিক্রম সিনহার মুক্তির জন্য জঙ্গীদের মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন৷ বিমল সিনহার বাবা এবং ভাই বিদ্যুৎ সিনহা মুক্তিপণের টাকার ব্যবস্থা করেন৷ কমলপুরের সিপিএম নেতা কমল কান্তি কর বিশেষভাবে জানান যে বিমল সিনহা জঙ্গী কবল থেকে অপহৃতদের মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে গোপন সমঝোতা করতেন৷ জঙ্গীদের সাথে বিমল সিনহার গোপন যোগাযোগ ছিল৷ শ্রী কর কমিশনকে আরও জানান, মুক্তিপণের টাকা জঙ্গীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা, জঙ্গীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিমল সিনহাকে হত্যা করা৷
এদিকে, কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, অভাঙ্গার বাসিন্দা শোভারাণী সিনহা জানিয়েছেন, বিমল সিনহা ও বিদ্যুৎ সিনহা তার বাড়িতে যায় এবং জঙ্গীদের সাথে তাদের ভাইয়ের মুক্তি বিষয়ে কিছু কথাবার্র্ত হবে বলে তাকে জানায়৷ ঠিক তারপরই হিমাংশু দাস, সত্য দাস, পরিমল দাস, প্রেমানন্দ নমশুদ্র, নৃপেন্দ্র নমশুদ্র, নির্মল দাস, শ্যামল দাস, রিপন দাস এবং সঞ্জয় দাসকে সঙ্গে তিন জঙ্গী ধলাই নদীর ওপাড় থেকে আসছে৷ শ্রীমতি সিনহা আরও জানান তিনি দেখেন দুই জঙ্গীর মুখে কাপড়ে ঢাকা এবং হাতে কোন কিছুকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে৷ নদীর ওপাড় থেকে দুই জঙ্গী এপাড়ে আসে এবং বিমল সিনহা ও বিদ্যুৎ সিনহা দুই হাত উপরে তুলে জঙ্গীদের সাথে দুই তিন মিনিট কথা বলেন৷ তারপরই জঙ্গীরা বিমল সিনহা এবং বিদ্যুৎ সিনহার উপর আগ্ণেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালায়৷
বুধবার বিধানসভায় পেশ করা ইউসুফ কমিশনের ১৬৯ পাতার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে দিকে লক্ষ্য রেখে রাজ্য সরকার কী ধরণের পদক্ষেপ নেবে কমিশনের সুপারিশ বিমল সিনহা এবং তাঁর ভাই বিদ্যুৎ সিনহার হত্যা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করা যাবেনা৷ উপজাতিদের অনেকদিন ধরে পোষণ করা ক্ষোভ এই ঘটনার বহিঃপ্রকাশ৷ উপজাতিদের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে তারা আইন সম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের আইন স্বীকৃত অংশ তারা হারিয়েছে৷ উপজাতিরা অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র এবং শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে৷ তাদের মধ্যে অনেকেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি তারা তা নয়৷ স্বাভাবিক কারণেই তারা সরকার এবং যারা সংখ্যাগিরষ্ট তাদের এই বোঝাতে চায় যে তাদের ওপর ন্যায্য বঞ্চনার থেকে মুক্তি পেতে এই ধরনের সহিংসপথ অবলম্বন করে থাকে, যাতে সরকার এই উপলব্ধি করে যে তাদের প্রতি সুবিচার করতে হবে৷ এই ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকার উপজাতি জনগণের সমস্যাগুলির দিকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে দেখতে হবে৷ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাসম্পর্কিত উন্নয়নে এমন ‘প্যাকেজ’ দিতে হবে যাতে উপজাতিরা মনে করে যে তাদের অভিযোগ নিরসনে সরকার যথেষ্ট তৎপর হতে হবে৷ সরকারকে খোলা মনে এবং পর্যাপ্ত ভাবে৷ উপজাতি ও অউপজাতিদের মধ্যে ঘৃণা যেভাবে দিনকে দিন বেড়ে চলেছে ত্রিপুরা রাজ্যে উন্নয়ন ও বিকাশের বিপজ্জনক অন্তরায় হয়ে উঠেছে৷ সরকার এই বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে৷ এই সব সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে হবে৷
রিপোর্টে আরও উল্লেখ রয়েছে, কমিশনের হাতে এমন সব তথ্য এসেছে যে ঐসব সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ওরা সন্ত্রাসবাদীদের বিভিন্ন অংশকে মদত দিয়েছে৷ যার ফলে সামগ্রিকভাবে ত্রিপুরা রাজ্যে জঙ্গীদের প্রভুত ক্ষমতার সৃষ্টি হয়েছে৷ কমিশন কোন রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করছে না৷ তবে, কমিশনের বলতে দ্বিধা নেই এই ধরনের ঘটনার কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মদত আছে৷ সমস্ত রাজনৈতিক দলকে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলতে হবে জনসাধারণের কল্যাণ ও উন্নয়নের স্বার্থে৷ যদিও বিমল সিনহা ব্যক্তিগত এবং উচ্ছাস ও আবেগ তাড়িত হয়ে কাজটি করতে এগিয়েছেন তার ভাইকে উগ্রপন্থীদের হাত থেকে বাঁচাতে৷ এই তদন্তে বিমল সিনহার ভূমিকাটি রাজ্য সরকারের কাছে একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ উগ্রপন্থীদের সমর্থকদের নিয়ে বিমল সিনহা উগ্রপন্থীদের সঙ্গে আপস মীমাংশা করতে গিয়েছিলেন৷ মন্ত্রীর এই ধরনের কাজ সমর্থনযোগ্য নয়৷ যাতে আর কোন মন্ত্রী এই ধরনের কাজে লিপ্ত না হন সেদিকে মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ নজর দেওয়া উচিত৷ উগ্রপন্থীদের মূল স্রোতে আনার প্রচেষ্টা স্বচ্ছ হতে হবে৷ কমিশনের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের সমস্ত আধিকারীকরা ত্রিপুরায় যে দাঙ্গা হয়েছে তারা এই ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন৷ এই কারণেই উপজাতিদের উপর পাশবিক বল বা তাদের হত্যা করে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না৷ তাদের বুঝিয়ে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং জীবনের সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করে উপজাতিদের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে৷
রাজ্যে বিদ্রোহের ভীতি প্রদর্শন কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তার চিন্তা করা এবং তার স্থায়ী সমাধান খঁুজে বের করা সরকারের করণীয় কর্তব্য৷ ভিআইপিদের হত্যা করা রোধ করে ত্রিপুরায় উগ্রপন্থী সমস্যা মেটানো যাবেনা, সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক ভাবে৷
ইউসুফ কমিশনের পেশ করা রিপোর্টে কমিশন যে মন্তব্য করেছেন তাতে দেখা গিয়েছে কমিশন দুঃখের সঙ্গে রাজ্যের সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে ওয়ার্ক কলচারের অভাব লক্ষ্য করেছে এবং লক্ষ্য করেছে নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের প্রতি উচ্চশ্রেণীর কর্মচারীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ চলছে এবং নিয়মানুবর্তিতার অভাব রয়েছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *