জেলেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বেশী, সেমিনারে জানালেন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতের বিচারপতি সেনগুপ্ত

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৮ ফেব্রুয়ারি৷৷ মানবাধিকারের প্রধান শর্ত কোনভাবেই যাতে বৈষম্য না হয়৷ এনিয়ে জোর সওয়াল করলেন তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যবিচারপতি তথা সিকিম লোকায়ুক্তের চেয়ারম্যান কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত৷ রবিবার প্রজ্ঞাভবনে মানবাধিকার শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাস্টিস সেনগুপ্ত বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জেলে কয়েদিদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ আবার চিকিৎসা পরিষেবাতেও চিকিৎসকরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকেন৷ কয়েদিদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ভিআইপি কয়েদি, সেলেব্রিটি এবং সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে প্রায়ই বৈষম্য করা হয়৷ DSC_0186অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাজ্য সরকারের সুপারিশে যেসব কয়েদি সংশোধনাগারে ভাল ব্যবহার করে থাকেন তাদেরকে সময়ের আগে মুক্তি দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে অনেক সময় বৈষম্য করা হয়৷ এই বৈষম্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল৷ সেক্ষেত্রে জেল আধিকারিকদের সংবেদনশীল হতে হবে৷ রাজ্য সরকারকেও নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে৷ জেল মূলত সংশোধনাগার৷ সেখানে কয়েদিদের মানবিক সংশোধনই মূল লক্ষ্য৷ একজন সাধারণ মানুষ এবং একজন কয়েদির মধ্যে মানবাধিকারের বিষয়ে কোন পার্থক্য থাকা চলবে না৷ তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, সাজাপ্রাপ্ত আসামী হলেও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তার অন্যান্যদের মতই সমান অধিকার রয়েছে৷ ভারতবর্ষের সংবিধান এই অধিকার তাদের প্রদান করেছে৷ জেল আধিকারিকরা এবিষয়ে সংবেদনশীল না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে৷ এক্ষেত্রে কোন কয়েদির পরিবারের তরফে অভিযোগ জানানো হলে সে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আইন রয়েছে৷
মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জাস্টিস সেনগুপ্ত বলেন,  অনেক সময় দেখা যায়, জেলে কয়েদিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়৷ তাতে কয়েদিরা রক্তাক্ত হন৷ মানবাধিকার আইন মোতাবেক জেলে প্রত্যেক কয়েদিদের নিরাপত্তা প্রদান করা জেল কর্তৃপক্ষের প্রধান এবং মুখ্য দায়িত্ব৷ এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলে এদিন তিনি মন্তব্য করেন৷ তিনি আরো বলেন, যারা পিছিয়ে পড়া কয়েদি রয়েছেন মানে যাদের সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে তাদের সাথে সহানুভূতি দেখানো উচিত৷ তাদেরকে আইনী সহায়তাও প্রদান করা উচিত৷ এমনও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনী সহায়তা জোগার করার সামর্থ্য থাকে না৷ সেক্ষেত্রে জেল কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে৷ যদি সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার কোন ব্যক্তি আইনী সহায়তা সহ আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে সাহায্য চেয়ে থাকেন তাহলে তাকে অবশ্যই সহায়তা করতে হবে৷ এক্ষেত্রে গাফিলতি কিংবা সাহায্য না করা হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলে তিনি উল্লেখ করেন৷  পাশাপাশি আরো বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সাজা শোনানো হচ্ছে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে কয়েদিদের মত আচরণ করা উচিত নয়৷ সেক্ষেত্রে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে৷ গ্রেপ্তার হওয়া কোন ব্যক্তি দ্রুত বিচার পাওয়া তার মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে৷ ফলে, তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে৷
এদিকে, স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসায় গাফিলতি করলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলে তিনি মন্তব্য করেন৷ তাঁর বক্তব্য, সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা কোন অবস্থাতেই রোগীদের চিকিৎসা করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না৷ সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানে সমানভাবে দায়বদ্ধ৷ কারণ, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের ডাক্তারি ডিগ্রি নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা থাকে৷ সরকারি অর্থানুকূল্যে চিকিৎসকরা তাদের ডিগ্রি নিয়ে থাকেন৷ ফলে, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা কোনভাবেই কোন রোগীর চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে নিজেকে এড়িয়ে রাখতে পারবেন না৷ কারণ, সেবামূলক পেশা হিসেবে চিহ্ণিত চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল৷ ফলে প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার সুনিশ্চিত করাই মানবাধিকার কমিশনের মূল লক্ষ্য, সে বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি৷ পাশাপাশি তিনি নারীদের সম্মান করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে বলেন৷ তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য নারীদের সম্মান সভ্যজাতির গুণ৷ যে জাতি নারীদের সম্মান দিতে জানে না তারা মূলত তাদের অস্তিত্বকে গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করে থাকেন৷
এদিন এই সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যমানবাধিকার কমিশনের সদস্য আর পি মিনা, সমীরণ দাস, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব বি কে সাহু, আইন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সচিব এ কে নাথ, রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মণিকা দত্ত রায় প্রমুখ৷ প্রত্যেকেই মানবাধিকার কমিশনের গুরুত্ব নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *