লাঠি-গুলি-গ্যাস, বামেদের ডাকা বনধের প্রভাব মিশ্র

কলকাতা ,৮ জানুয়ারি (হি.স): গোটা রাজ্যেই বুধবার মিশ্র প্রভাব পড়ল বাম ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকা ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটে । সকাল থেকেই বনধ সমর্থকারীরা রাস্তায় নামায় বিচ্ছিন্ন গন্ডগোলের খবর আসতে শুরু করে বিভিন্ন জেলা থেকে । রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই রেল ও সড়ক অবরোধের ফলে ব্যাহত হয় জনজীবন ।  রাজ্যের সর্বত্রই বনধের মিশ্র সাড়া লক্ষ্য করা গেছে ।

যদিও এদিন বনধ ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে মালদার সুজাপুরে । ৩৪নং জাতীয় সড়কে অবরোধ তুলতে গিয়ে ধর্মঘটীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক ধস্তাধস্তি বাধে । এরপরই পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছোড়ার অভিযোগ ওঠে বনধ সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে । এর জেরে এক পুলিশকর্মীর মাথা ফেটে যায় বলে খবর । পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি চালায় পুলিশ । ধর্মঘটীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। শূন্যে গুলিও ছোড়ে । পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ । মালদার জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার দাবি, সুজাপুরে ধর্মঘট সমর্থকদের উপর চড়াও হওয়ায় অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের শনাক্ত করা হয়েছে । তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে ।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর দাবি, ‘যোগীর থেকেও নৃশংস মমতার পুলিশ ।’ সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম বুধবার বিস্ফোরক অভিযোগ করেন । বলেন, ভাইপোকে বাঁচাতে, আর্থিক কেলেঙ্কারিকে ধামাচাপা দিতে আজকের ধর্মঘটে দালালি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মমতাকে চড়া সুরে আক্রমণ করে বুধবার বিকালে সেলিম বলেন, ‘গোটা দেশে মোদী-শাহ যা করছেন, মমতাও তাই করছেন ।‘ একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বনধে বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দুষে সেলিম বলেন, ‘মমতা প্ররোচনা দিয়েছেন । তারপরই তৃণমূলের গুন্ডা ও পুলিশ হামলা চালিয়েছে । কিন্তু, গোটা রাজ্যে তা করতে পারেনি । এতে প্রমাণিত হয়েছে যে সব জায়গায় মমতার দাপট চলে না’। সুজাপুরে গাড়ি ভাঙচুরের প্রসঙ্গ তুলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেন তিনি। বলেন, ‘মমতার পুলিশ গাড়ি ভাঙচুর করেছে ।’

আজ যৌথভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে বাম কংগ্রেস । সিটু নেতৃত্বের দাবি, ২০১১ সালের পর এমন সাফল্য আসেনি । মমতার বক্তব্যকে আর্তনাদ বলে মনে হচ্ছে । উনি ভাবতেই পারেননি ধর্মঘট এত সর্বাত্মক হবে । সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘সুজাপুরে যা হয়েছে তার দায় কেবলমাত্র যারা ভাঙচুর করেছে তাদের । এই ঘটনার দায় আমরা নেব না । রেললাইনে বোমা রাখা বিচ্ছিন্ন ঘটনা । এইভাবে যারা হরতালকে কালিমালিপ্ত করেছে তাদের দায় আমাদের নয় ।‘ধর্মঘট সম্পূর্ণরূপে সফল বলে  দাবি করেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য । তিনি বলেন, ‘ধর্মঘট সমর্থনকারীরাই আসল দেশপ্রেমিক।‘

আজ বাজার, স্কুল খোলা ছিল প্রায় সমস্তই । অফিসে হাজিরাও ছিল স্বাভাবিক । ধর্মঘটের সমর্থনে সকাল থেকে রাস্তায় নামেন আন্দোলনকারীরা । ধর্মঘটীদের আচরণে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । গঙ্গাসাগর থেকে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের নামে গুন্ডামি চলছে । ট্রেনের নীচে বোমা রাখা গুন্ডাগিরি । মারপিটে বিশ্বাস করি না । সরকারি সম্পত্তি যারা নষ্ট করছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ।‘ বামেদের কটাক্ষ করে এদিন তিনি আরও বলেন, ‘এই করতে করতে পার্টিটা সাইন বোর্ডে এসে ঠেকেছে ।‘
বুধবার বন্ধ সমর্থনকারী ও পুলিশের মধ্যে হাতাহাতিতে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায় কোচবিহারের কাছারির মোড়ে । পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বাধে বনধ সমর্থনকারীদের । আন্দোলনকারীরা উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাস আটকালে পুলিশ বাধা দেয় । তখনই শুরু হয় সংঘর্ষ । পরে পুলিশের পাহারায় যাত্রীদের নিয়ে রওনা হয় বাস । তুফানগঞ্জের থানা মোড়েও একটি সরকারি বাসে ভাঙচুর চালায় আন্দোলনকারীরা । এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন । বামেদের মিছিল দেখে যাত্রী বোঝাই বাস রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাস চালক । পুলিশ তাকে খুঁজে নিয়ে এসে বাস রওনা করায় । দুপুরে ধর্মঘটের সমর্থনে আলিপুরদুয়ারের বি এস রোডে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন আলিপুরদুয়ারের যুব কংগ্রেস সভাপতি শান্তনু দেবনাথ । গ্রেফতার করা হয় তাঁকে ।
সিউড়ি সহ বীরভূমের অন্যান্য অংশে সকাল থেকেই মানুষের জীবনযাত্রা ছিল মোটের উপর স্বাভাবিক । সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে সকালবেলায় প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ চলে । সেই সময় বাস চলাচলে ব্যাঘাত হলেও পরে পুলিশ এসে তাঁদের হটিয়ে দেয়।

মালদহের কালিয়াচকের সুজাপুরের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বাম এবং কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকরা । অবরোধ তুলতে গেলে পুলিশ এবং ধর্মঘটীদের ধস্তাধস্তি । পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়া হয় । ইটের ঘায়ে মাথা ফাটে এক পুলিশকর্মীর। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি গাড়িতে। করা হয় বোমাবাজি । পরিস্থিতি সামাল দিতে কাঁদানে  গ্যাসের শেল ছোঁড়ে পুলিশ । সূত্রের খবর, শূন্যে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিও চালানো হয় ।  

বিজেপি সংসদ স্বপ্ন দাশগুপ্তকে আটকাতে রাস্তায় শুয়ে বিক্ষোভ দেখায় বিশ্বভারতীর বামপন্থী পড়ুয়ারা । গেটে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভের জেরে আংশিক ভাবে ব্যাহত পঠনপাঠন । শিলিগুড়িতে জোর করে রাস্তা অবরোধ করায় ১০ জন এসইউসিআই কর্মী সমর্থককে আটক করল পুলিশ ।

সকাল ১১ টা ৪০ নাগাদ জলপাইগুড়ি আদালতের বিচারকদের গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করে ধর্মঘটীরা । সকালে বর্ধমানে পার্কাস রোডের মোড়ে ধর্মঘটীরা রাস্তা অবরোধ করায় আটকে পড়ে বিভিন্ন যানবাহন । কিছুক্ষণ জিটি রোডেও চলে অবরোধ । মিছিল থেকে গাড়ির কাঁচ ভেঙে দেওয়া হয় । পেট্রোল পাম্পে গিয়ে তছনছ করে পাম্প বন্ধ করে দেওয়া হয় । টোটো থেকে যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেওয়ার বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে । ধর্মঘটীরা স্কুল বন্ধ করতে গেলে অশান্তির সৃষ্টি হয় বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের গেটে । বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের সামনে জোর করে স্কুলে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় অভিভাবকরা এবং বনধ সমর্থকদের ধস্তাধস্তি । এসএফআই কর্মী-সমর্থকরা কয়েকজন শিক্ষককে স্কুলে ঢুকতে বাধা দেন । সেই সময় কয়েকজন অভিভাবক প্রতিবাদ করেন । মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারধর করা হয় এসএফআই-এর পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক অনির্বাণ রায়চৌধুরীকে । এসএফআই-এর অভিযোগ, তৃণমূলের লোকজন হামলা করেছে । তৃণমূলের পালটা দাবি, অভিভাবকরাই প্রতিরোধ করেছেন । বর্ধমানের বীরহাটা ও পারবীরহাটা এলাকায় বাস-সহ অন্যান্য যানবাহনে মিছিল করে এসে হামলা করে ধর্মঘটীরা। কয়েকটি বাস, গাড়ি ও টোটো ভাঙচুর করা হয়। টোটো থেকে জোর করে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষজন। বনধ সমর্থকদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি স্কুলবাসগুলিও। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তবে বাজারহাট, দোকান খোলা। জিটি রোডে ঢলদিঘি মোড়ে একটি পেট্রল পাম্প খোলা থাকায় ভাঙচুর চালায় ধর্মঘট সমর্থকরা ।  

বনধের সমর্থনে মিছিল ছিল ভাতার বাজারে । ওই মিছিল থেকে একটি লরিতে ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ । ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে পুলিশ কর্মীদেরও হেনস্তা করা হয় । বর্ধমান-হাওড়া মেইন ও কর্ড শাখায় ট্রেন চলাচল অবশ্য স্বাভাবিক ছিল ।

বনধের সমর্থনে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায় দুর্গাপুরে । ভাঙচুর করা হয় একটি সরকারি বাস ও রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের একটি গাড়ি । এদিন সকালে নিউটাউনশিপ থানার খয়রাশোল পেট্রল পাম্পের কাছে জাতীয় সড়কের দুটি লেনে বসে পড়েন বনধ সমর্থনকারীরা । অবরোধ চলাকালীন হঠাৎই বনধ সমর্থকরা উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার একটি বাসে ব্যাপক ভাঙচুর করে । ভাঙচুর চালানো হয় রাজ্য বিদ্যুৎ পরিষদের একটি গাড়িতেও । এই অশান্তি চলতে চলতেই হঠাৎই বনধ সমর্থকরা তেড়ে যায় এক বাইকচালকের দিকে । গৌরাঙ্গ রুইদাস নামে বেসরকারি সংস্থার ঐ কর্মীকে পুলিশের সামনেই ব্যাপক মারধর করে মুখ ফাটিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ । রক্তাক্ত অবস্থায় ঐ বাইকচালককে বনধ সমর্থকদের হাত থেকে কোনওরকমে উদ্ধার করে নিয়ে যায় পুলিশ । উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায় । পরিস্থিতির সামাল দিতে ঘটনাস্থলে আসে বিশাল পুলিশ বাহিনী ।
খয়রাশোলের কাছে বনধ সমর্থকদের অবরোধের জেরে আটকে পড়েন বিজেপির এক শিক্ষক নেতা । এই সময় ওই বিজেপি নেতার সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন বনধ সমর্থকরা । ঘণ্টা খানেকের এই অবরোধের জেরে ব্যাপক যানজট তৈরি হয় দুই নম্বর জাতীয় সড়কে । পড়ে পুলিশ জাতীয় সড়কের দুটি লেন যানজট মুক্ত করে ।

সকালে হাওড়া ড্রেনেজ ক্যানাল রোডের বেলেপোল ক্রসিংয়ে অবরোধ করে বনধ সমর্থকরা । আটকে দেওয়া হয় এই পথে চলাচলকারী সমস্ত গাড়ি । জোর করে নামিয়ে দেওয়া হল বাস ও টোটোর যাত্রীদের । ঠিক মতো বাস না পেয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা ।

সকালে কোচবিহারে জোর করে স্টেট ব্যাংক বন্ধের চেষ্টা করে ধর্মঘট সমর্থনকারীরা । তাদের গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ । খুলল স্টেট ব্যাংক । মহেশতলার নুঙ্গি ও আকড়া স্টেশনের মাঝে বাটা ব্রিজের তলায় বোমা উদ্ধার হয় । ঘটনাস্থলে যায় রেলপুলিশ এবং মহেশতলা থানার পুলিশ । বেলা ১২ টা নাগাদ বারাসত স্টেশনের কারশেড থেকে দু’টি বোমা উদ্ধার হয় । শ্যামনগরে রেল অবরোধকারীদের লাঠিচার্জ করে পুলিশ ।

সকাল ১১ টা নাগাদ ধর্মঘট ঘিরে যাদবপুরে ধুন্ধুমার কান্ড হয় । পুলিশের গাড়ি এবং বাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালান ধর্মঘট সমর্থকরা । বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা । মারমুখী ধর্মঘটীদের লাঠিচার্জ করে পুলিশ । নামানো হয় ব়্যাফ । আটক করা হয় সিপিএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী সহ বেশ কয়েকজনকে ।

বাম-কংগ্রেস যৌথভাবে শ্রীরামপুর স্টেশনে রেল অবরোধ করে । অবরোধকারীদের গলায় ছিল পিঁয়াজ, আলুর মালা । শিয়ালদহ-ডায়মন্ড হারবার শাখার ধামুয়া ও সংগ্রামপুর স্টেশনে রেলের ওভারহেড তারে কলাপাতা ফেলে দেয় ধর্মঘট সমর্থনকারীরা । ফলে সকালের দিকে বেশ কিছুক্ষণ এই শাখায় ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।  পাশাপাশি শিয়ালদহ-বজবজ শাখার নুঙ্গিতে ট্রেন অবরোধ ধর্মঘট সমর্থকদের । ডায়মন্ড হারবারের মগরাহাট স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করা হয় । বনধ ব্যর্থ করতে পথে নাম তৃণমূল । হাওড়ার পাঁচলায় মুম্বই রোড অবরোধ করে ধর্মঘটীরা ।

সকালে দমদম মেট্রো স্টেশনে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করে ধর্মঘট সমর্থকরা । তবে তাতে বাধা দেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ । আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলার পর ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান ধর্মঘটীরা । বারাসত-হৃদয়পুরে স্টেশনের মাঝে রেললাইনের উপর বোমা রাখার অভিযোগ উঠল ধর্মঘট সমর্থকদের বিরুদ্ধে । তার জেরে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল । পরে রেলপুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দু’টি কৌটো বোমা উদ্ধার করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *