সুন্দরবনের নিখোঁজ যুবক সাত বছর পর উদ্ধার নতুনবাজারে

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৫ অক্টোবর ৷৷ ত্রিপুরা পুলিশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নিখোঁজ ছেলেকে ফিরে পেল প্রত্যন্ত এলাকার এক জনজাতি দম্পত্তি৷ টানা সাতবছর যাবৎ নিখোঁজ থাকার পর পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা থেকে নিখোঁজ যুবককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে নতুনবাজার থানার পুলিশ৷ ছেলেকে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত তার মা-বাবা৷ করবুক মহকুমার পশ্চিম মাণিক্য দেওয়ান এডিসি ভিলেজের দেওয়ান পাড়ার বাসিন্দা নন্দরায় ত্রিপুরার বড় ছেলে বাবুসা ত্রিপুরা সাতবছর আগে নিখোঁজ হয়ে যায়৷ তখন অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলেও ছেলের কোন হদিশ পায়নি পরিবারের লোকজন৷ প্রায় সাতবছর আগে শিলাছড়িতে রাস্তার কাজ করাতে আসা বহির্রাজ্যের জনৈক ব্যক্তির সাথে গুয়াহাটি চলে যায় বাবুসা ত্রিপুরা৷


তাকে সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কিন্তু পরিবারের লোকেদের কিছু না জানিয়েই বাবুসা ত্রিপুরা বহির্রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল৷ ভেবেছিল টাকা রোজগার করে একদিন বাড়ি ফিরে আসবে৷ কিন্তু সেই ভাগ্য আর হলো না৷ কারণ গুয়াহাটিতে নিয়ে গিয়ে তাকে দিয়ে গাঁধার খাটুনি খাটানো হলেও দৈনিক কেবলমাত্র ১০০ টাকা মজুরি দেওয়া হতো৷ বাড়িতে ফিরে যাবার কথা বললে তার হাতে কোন টাকা দেওয়া হতো না৷ শুধুমাত্র খাবার দেওয়া হতো৷ এইভাবে দীর্ঘ চার বছর চলার পর একদিন বাবুসা সহ পাঁচজন শ্রমিককে জঙ্গলের ভেতরে একটি রাস্তা নির্মাণ করার জন্য পাঠানো হয়৷ শুধুমাত্র সাতদিনের খাবারের সরঞ্জাম দিয়ে তাদের কাজে পাঠানো হয়েছিল৷ কিন্তু সাতদিনের জায়গায় দশদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও ম্যানেজার কিংবা ঠিকাদারের কোন খবর নেই৷
বাবুসা ত্রিপুরার হাতে একটি টাকাও ছিল না, ফলে খাওয়ার কোনও সংস্থান ছিল না৷

পরবর্তী সময় অন্য শ্রমিকদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের কোন এক জায়গায় পৌঁছায় সে৷ কিন্তু সেখানেও বাবুসা ত্রিপুরাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় অন্য শ্রমিকরা৷ তারপর থেকে অসহায় দিন যাপন শুরু হয় বাবুসা ত্রিপুরার৷ প্রায় দশদিন শুধুমাত্র জল খেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে৷ সহায় সম্বলহীন জনজাতি যুবককে কেউ কাজে রাখেনি৷ গায়ে পরিহিত নোংরা জামাকাপড় দেখে সকলে তাকে দুর দুর বলে তাড়িয়ে দেয়৷ এভাবেই হাটতে হাটতে সে একদিন সুন্দরবন এলাকার একটি নৌকা ঘাটে গিয়ে পৌঁছায়৷ সেখানে কিছুদিন থাকার পর নৌকা ঘাটে খালাসির কাজ পায় সে৷ নৌকাতে বিভিন্ন সামগ্রী তোলা নামা করে দৈনিক ৫০-১০০ টাকা রোজগার করত৷ মাঝে মধ্যে নৌকাও চালাতে হতো৷


দৈনিক যা পেত তা দিয়ে কোনরকম খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে ছিল বাবুসা ত্রিপুরা৷ নৌকাঘাটের বিশ্রামাগারে রাত কাটাতে হতো তাকে৷ ঐ সুন্দরবন এলাকার মাস্টার নামক এক ব্যক্তি বাবুসার করুণ অবস্থা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরলে করবুকের বৈরাগী দোকান এলাকার গকুল ত্রিপুরা গ্রামের ছেলে বাবুসাকে চিনতে পারে৷ ছেলের করুণ অবস্থা জানতে পেরে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে তার মা-বাবা উদগ্রীপ হয়ে উঠেন৷ কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া ওই পরিবারটির পক্ষে সম্ভব ছিল না পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে ছেলেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার৷ অসহায় মা-বাবা নতুনবাজার থানার দ্বারস্থ হন৷ ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে নতুনবাজার থানার ওসি বাপি দেববর্মার নিকট করুণ আর্জি জানান তারা৷

ওসি বাপি দেববর্মা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান৷ তারপর রাজ্য আরক্ষা প্রশাসনের নির্দেশ মোতাবেক নতুনবাজার থানার সাব ইনস্পেক্টর দেবব্রত সিন্হা ও কনস্টেবল জগন্নাথ বণিক-কে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হয়৷


বাবুসা ত্রিপুরার পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার যুবক সুরজিৎ ত্রিপুরাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়৷ অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার পুলিশের সহায়তায় সুন্দরবন এলাকা থেকে বাবুসা ত্রিপুরাকে উদ্ধার করেন নতুনবাজার থানার সাব ইনস্পেক্টর দেবব্রত সিন্হা ও কনস্টেবল জগন্নাথ বণিক৷ তাকে জামাকাপড় কিনে দেওয়া হয়৷ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাবুসাকে নিয়ে নতুনবাজার থানায় পৌঁছায় পুলিশের টিমটি৷ ছেলে আসার খবর পেয়ে আগে থেকেই থানায় এসে উপস্থিত ছিলেন তার মা-বাবা৷ দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর তারা কখনও ভাবেননি ছেলেকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবেন৷ বাবুসা ত্রিপুরা জানায়, বিগত সাতবছর যেভাবে অসহায় দিন যাপন করেছে তাতে সে স্বপ্ণেও ভাবেনি কোনোদিন বাড়িতে ফিরে আসতে পারবেন৷ ত্রিপুরা পুলিশের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে৷ নতুনবাজার থানার এ ধরনের ভূমিকার জন্য এলাকাবাসীরা সাধুবাদ জানিয়েছেন৷ সাব ইনস্পেক্টর দেবব্রত সিন্হা ও কনস্টেবল জগন্নাথ বণিক-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ এলাকাবাসী৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *