বিশেষ প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৫ মার্চ৷৷ চোর কভু নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী৷ সে হোক শিক্ষিত বা মূর্খ চোর৷ যাদের অস্থিমজ্জায় চুরির স্বাদ লুক্কায়িত তাদের ক্ষেত্রে স্থান পাত্র কাল এই তিনটি বিষয় কখনও প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠে না৷ রাজ্যে রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, রাজ্যবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত এবং স্বচ্ছ প্রশাসন উপহার দেবেন৷ তা যে শুধুমাত্র ভাষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আসতে শুরু হয়েছে৷ রাজ্যে যাদের মাধ্যমে রাম রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে তারাই আজ আপাদ মস্তক দুর্নীতিতে ডুবে আছে৷ অর্থাৎ সর্ষের মধ্যেই ভূত বিরাজমান৷

রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের বহু চর্চিত ও বিতর্কীত নাম হল আইপিএস জয়দ্বীপ নায়েক৷ বর্তমানে তিনি পুলিশের সদর দপ্তরে বসে কারা দপ্তরের আইজি (প্রিজন) এর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন৷ কে এই জয়দ্বীপ নায়েক? একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক৷ ১৯৯১ সালের এসটি ক্যাডারের এক আইপিএস অফিসার এই জয়দ্বীপ নায়েক৷ গত ২০১১ সালে ত্রিপুরা থেকে তিনি উড়িষ্যার আইজি পদে ডেপুটেশানে চলে যান৷ সেখানে ২৪.৮.২০১২ থেকে ৩১.১২.২০১৫ তারিখ পর্যন্ত তিনি উড়িষ্যা পুলিশের হিউম্যান রাইট্স প্রোটেকশান সেলের দায়িত্বে থাকার সময়ে এসসি এসটি ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের নামে, কম্পিউটার না কিনে প্রায় ৪৪ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন এই নায়েক৷ এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসে ডেপুটেশান শেষ হওয়ার পর তিনি ত্রিপুরায় এসে অগ্ণিনির্বাপক দপ্তরের অধিকর্তার পদে যোগ দেন৷
এই বিশাল অংকের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই উড়িষ্যার ভিজিল্যান্স শাখায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়৷ এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রেপ্তার এড়াতে জয়দ্বীপ নায়েক আত্মগোপন করে রাজ্য প্রশাসনে হৈই চৈই ফেলে দিয়েছিল৷ পরবর্তী সময়ে ২৩.০৭.২০১৬ তারিখে উড়িষ্যার পুলিশের এক বিশেষ টিম তাঁকে গাজিয়াবাদ থেকে গ্রেপ্তার করে উড়িষ্যাতে নিয়ে যায়৷ গ্রেপ্তারের পর ত্রিপুরা সরকার তাঁকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে৷ পরবর্তী সময়ে জামিনে মুক্ত হয়ে জয়দ্বীপ নায়েক ত্রিপুরা পুলিশে পুণরায় যোগদান করেন৷ প্রশ্ণ হল, মামলা চলাকালীন সময়ে তিনি কিভাবে চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন?
জানা গিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী কুমার অলকের খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তিনি কারা দপ্তরে আইজি (প্রিজন) এর দায়িত্ব পেয়ে যান৷ আর তারপর থেকেই নায়েক আবার স্বমহিমায় নিজেকে দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ড হিসাবে তুলে ধরেন৷ কারণ তাঁর অস্থিমজ্জায় সরকারী টাকা আত্মসাতের নেশা লুক্কায়িত৷ সংবাদ সূত্রে প্রকাশ, দুই বছর পর আবার তিনি অবৈধভাবে কম্পিউটার কেনার দায়ে অভিযুক্ত হলেন৷
গত ১১ই জানুয়ারী মেমোরেন্ডাম নং এফ.৬(২১)/জেইল/২০১৪/২৮১-৮৩ এবং নং.৬(২১)/জেইল/২০১৪/২৮৪-৮৬ এর মাধ্যমে বিনা টেন্ডারে আটটি ডেল কম্পিউটার কেনার দাম বাবদ গোবিন্দ সমবায় সমিতির ম্যানেজারের নামে মোট ৩ লক্ষ ১৮ হাজার ৩৬০ টাকা অনুমোদন দিয়েছেন৷
এই দুই মেমোরেন্ডামে তিনি উল্লেখ করেছেন, ডিএফপিআরটি-১৭ এর ১০(১) ধারা মোতাবেক তিনি এই অনুমোদন দিয়েছেন৷ আশ্চর্য্যের বিষয় হল ডিএফপিআরটি-১৭ এর উল্লেখিত ধারা মোতাবেক দপ্তরের প্রধান রেকারিং এক্সপেন্ডেচারের বেলায় দুই লক্ষ টাকা খরচ করতে পারবে৷ তাও আবার অর্থ দপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষ৷ গত ৭ই জুলাই, ২০১৭ তারিখে অর্থ দপ্তরের মেমোরেন্ডাম নং.এফ.১০(৬)-এফআইএন(জি)/২০১০ এর পয়েন্ট নং (১১) তে পরিস্কার বলা আছে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ফটোকপিয়ার, স্ক্যানার, এলসিডি প্রজেক্টার, ফ্যাক্স, ক্যামেরা, টিভি কেনার আগে ডিএফপিআরটি এর সকল নিয়ম কানুন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করে কিনতে৷
উল্লেখ্য , ত্রিপুরা হাইকোর্টের এক জনস্বার্থ মামলা নং, ডব্লিওপি(সি)ঃ পিআইএল/০২- অব ২০১৩ এর রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যসচিব একটি মেমোরেন্ডাম নং এফ.৯(২)-এফআইএন(জি)/২০০৭ তারিখ ০৭.০৭.২০১৪ ইসু করেন৷ এতে পরিস্কার উল্লেখ আছে যে, কোন দপ্তর প্রধান বা সচিবরা যেন কোন টেন্ডার/দরপত্র ছাড়া কোন প্রকার অফিস সামগ্রী ক্রয় না করে৷
প্রশ্ণ হল, এই নির্দেশনামা থাকা সত্বেও ই-টেন্ডারের যুগে জয়দ্বীপ নায়েক বিনা টেন্ডারে কিভাবে বেআইনীভাবে এই আটটি কম্পিউটার ক্রয় করলেন৷
ডিএফপিআরটি-২০১৭ মোতাবেক কোন টেন্ডার বা কোটেশান ছাড়া এলপিসি, এইপিসি এর অনুমোদন নিয়ে দপ্তরের ২৫০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকার অফিস সামগ্রী কেনা যাবে৷
জানা গেছে, দপ্তরের সচিব বি কে শাহু এবং অর্থ দপ্তরকে ঘুমে রেখে এলপিসি এবং এইচপিসির অনুমোদন ছাড়াই জয়দ্বীপ নায়েক প্রিজন ডাইরেক্টরেটের একাউন্টেন্ট লক্ষ্মণ দেববর্মার সহযোগে এই কম্পিউটারগুলি কিনেছেন৷
উল্লেখ্য, ডিএফপিআরটির ১৫ নং ধারা অনুসারে কোন অফিসের প্রধান, কোন কনজিওমার ফেডারেশান, প্রাইমারী মার্কেটিং সোসাইটি, টিএসআইসি এবং টিকেআইভিসিথেকে বছরে সর্বোচ্চ ১.৫ লক্ষ টাকার অফিস সামগ্রী সরাসরি কিনতে পারবে৷ আর টাকার পরিমাণ ১.৫ লক্ষের বেশী হলেই দপ্তরের সচিবের অনুমোদন নিতে হবে৷ নায়েক সাহেব কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই এই আটটি কম্পিউটার ক্রয় করেছেন বলে অভিযোগ৷
অবাক করার বিষয় আইজি(প্রিজন) কিভাবে বিনা টেন্ডারে এবং কোন সাপ্লাই অর্ডার ছাড়া আগরতলার নেতাজী মার্কেটের গোপাল গোবিন্দ ব্যবহারিক সমবায় সমিতিকে ৩ লক্ষ ১৮ হাজারহ ৩৬০ টাকা মিটিয়ে দিতে সেংশান মেমোতে স্বাক্ষর করলেন? আশ্চর্য্যের বিষয় সমবায় সমিতি দ্বারা আইজি (প্রিজন) এর নিকট ১৬.০১.২০১৯ তারিখে দাখিলকৃত ইনভয়েস নং ১৮৯৫ এর মধ্যে কোন সাপ্লাই অর্ডারের উল্লেখ নেই৷ প্রশ্ণ হল, সাপ্লাই অর্ডার ছাড়া এই সমবায সমিতিই বা কিভাবে আটটি কম্পিউটার সরবরাহ করল? আর এতেই সংশ্লিষ্ট মহলে গুঞ্জন শুরু হয়েএছ৷ বাস্তবে কি কম্পিউটার কেনা হয়েছে?