নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৮ মে ৷৷ প্রকৃতির রুদ্ররূপ রাজ্যে ভয়াল আকার ধারণ করেছে৷ প্রবল বর্ষণে চার জনের মৃত্যর পাশাপাশি বহু বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ বৃষ্টির জলের ঝাঁপটায় বহু মানুষকে ঘড় ছেড়ে ত্রান শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে৷ শুক্রবার ভোর থেকে অবিরাম বর্ষণে

রাজধানী আগরতলা প্লাবিত হয়েছে৷ বণমালীপুর সহ আগরতলায় বেশ কয়েকটি স্থান দীর্ঘ সময় ধরে জলমগ্ণ রয়েছে৷ শহরবাসীর সহায়তায় নৌকা নামাতে হয়েছে৷ দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তর জানিয়েছে, আজ পশ্চিম ও খোয়াই জেলায় ৩৪টি ত্রান শিবির খোলা হয়েছে৷ তাতে ১০ সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন৷ বিমান বন্দর স্থিত আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ভোর চারটা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৪২.৬ এমএম৷ এদিকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরোও ১২.২ এমএম বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ দিল্লিস্থিত মৌসম বিভাগে আবহাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ি অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুন হবে৷
মোহনপুর মহকুমার হেজামারা ব্লকে গতকাল রাতে অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে বসতবাড়ী ভেঙ্গে মাটি চাপা পড়ে এক পরিবারের তিন জনের এবং অপর এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে৷ ঘটনাটি ঘটেছে হেজামারা ব্লকের কাম্বুকছড়া এডিসি ভিলেজের সুবলসিং বৈরাগী মুড়ার গোবিন্দ পাড়ায়৷ গতকাল রাতে অবিরাম বৃষ্টির ফলে বড়মুড়ার পাহাড়ের মাটি ধবসে পড়ে সুবল সিং বৈরাগী মুড়ার গোবিন্দ পাড়ায় সানিরাম দেববর্মার বসত বাড়ির উপর৷ এতে সানিরাম দেববর্মার বসতবাড়ী ভেঙ্গে পড়ে৷ মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয় সানিরাম দেববর্মা (৩৫), তার স্ত্রী অমৃতবালা দেববর্মা (৩০) এবং তাদের ছোট ছেলে অভি দেববর্মা (৩)৷ এই ঘটনায় সানিরাম দেববর্মার অপর ছেলে দীপঙ্কর দেববর্মা (৮) গুরুতর আহত হয়েছে৷ সে এখন জিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ সকালে এলাকাবাসীর নজরে পড়ে এই মর্মান্তিক ঘটনা৷ এলাকাবাসীরাই মাটি সরিয়ে মৃতদেহ তিনটি উদ্ধার করে৷ অপরদিকে কাম্বুকছড়া এডিসি ভিলেজের বেলফাঙে আরো এক জনের মৃত্যু হয়েছে৷ মৃত ব্যক্তির নাম মলিন্দ্র দেববর্মা (৫০)৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ঘোষণা করেছেন মৃত পরিবারের আত্মীয়কে ৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে এবং বন্যায় যাদের ঘরবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পুননির্মাণের জন্য ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে৷ তাছাড়াও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, অবিরাম বৃষ্টিতে ত্রিপুরার বহু এলাকা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন৷ তিনি জানান, ত্রিপুরা সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের শীঘ্রই সম্ভাব্য যাবতীয় সহায়তা দেবে৷ ঘটনার খবর পেয়েই মোহনপুর মহকুমার শাসক প্রসূন দে ঘটনাস্থলে ছুটে যান৷ পরে শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ, উপজাতি কল্যাণ মন্ত্রী মেবার কুমার জমাতিয়া, বিধায়ক বৃষকেতু দেববর্মা, হেজামারা ব্লক বি এ সি’র চেয়ারম্যান সুনীল দেববর্মা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন৷ পশ্চিম জেলার জেলাশাসক ড সন্দীপ এন মাহাত্মেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ মোহনপুর মহকুমা প্রশাসন থেকে মৃত ব্যক্তিদের নিকট আত্মীয়কে প্রাথমিক সহায়তা হিসাবে ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে৷
এদিন ভোর চারটা থেকে অবিরাম বর্ষণ শুরু হয়৷ সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাতে আগরতলা শহর ও শহরতলীর বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ণ হয়ে পড়ে৷ আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, গত কয়েকদিনের মধ্যে আজকেই সল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ ভোর চারটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত বৃষ্টি পরিমাণ ছিল ২৪২.৬ এমএম৷ সন্ধ্যা পর্যন্ত আরোও ১২.২ এমএম বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ আবহাওয়া বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাক্ বর্ষায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬৯১.৬৭ এমএম৷ শুধু তাই নয়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৭৪৪.১ এমএম বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ দিল্লিস্থিত মৌসম বিভাগের দাবি আগামী দিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরোও বাড়বে৷ গত বেশ কয়েক বছরের তুলনায় এবছর প্রায় দ্বিগুন বৃষ্টিপাত হবে৷ এবছর এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তাও স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন৷ ফলে, প্রকৃতির ভয়াল রূপ রাজ্যবাসীর জন্য আরোও অপেক্ষা করছে বলেই মনে হচ্ছে৷

প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী এদিন ভারি বর্ষণে খোয়াই ও পশ্চিম জেলায় ৩২টি ত্রান খোলা হয়েছে৷ খোয়াই জেলায় ২৫টি এবং পশ্চিম জেলায় ২০টি ত্রান শিবিরে ১০ সহাস্রাধিক মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন৷ জানা গেছে, খোয়াই জেলায় পদ্মবিল ও কল্যাণপুরে বিভিন্ন সুকল, অঙ্গনয়াড়ি সেন্টার ও আইসিডিএস সেন্টারে ত্রান শিবির খুলেছে৷ এদিকে পশ্চিম জেলায় মোহনপুর ও সদর জেলায় ত্রান শিবির গুলি খোলা হয়েছে৷ শিবির গুলিতে প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গেছে, অন্তত ১৮৬৫ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে৷ পশ্চিম জেলায় শিবির গুলিতে সর্বাধিক সবচেয়ে বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে৷ প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ভারি বর্ষণে ৩৩২টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে৷ তবে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
এদিকে, হেজামারা নিহতদের খোঁজ খবর নেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিগত পঁচিশ বছরে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সঠিকভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপায়িত হয়নি৷ এনিয়ে আমি কাউকে দোষারোপ করব না৷ তবে জনজাতি অংশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে আমার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাগোযোগ ব্যবস্থা, পানীয় জল প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিকল্পনা রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ তিনি জানান, তাঁর পরিদর্শনের সময়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তাঁকে ফোন করে রাজ্যের সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবরাখবর নেন৷ এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় সবধরণের সহায়তা করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন৷ পরিদর্শনকালে বিধায়ক বৃষকেতু দেববর্মা, মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান সচিব কুমার অলোক, অতিরিক্ত সচিব ডা মিলিন্দ রামটেকে, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার জেলা শাসক সন্দীপ এন মাহাত্মো, মহকুমা শাসক প্রসূন দে ও অন্যান্য আধিকারিকরা উপস্থিত ছিলেন৷

এদিকে আজ ভোর থেকেই প্রবল বর্ষণের ফলে রাজধানী আগরতলা শহর জলপ্লাবিত হয়ে পড়ে৷ এর ফলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে৷ যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷ জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে পড়েগ্গ৷ মুখ্যমন্ত্রী আজ সকালের বিমানে কোলকাতা থেকে আগরতলায় এসেই রাজধানীর জলপ্লাবিত বনমালীপুর এলাকা পরিদর্শন করেন৷ তিনি জলমগ্ণ বাড়িগুলোও ঘুরে দেখেন৷ এসময় তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সুখময় সেনগুপ্তের বাড়িতেও যান এবং পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেন৷ জলমগ্ণ বনমালীপুরবাসীর সঙ্গেও তিনি কথা বলেন৷ দুর্গত মানুষ এলাকায় অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি কভার ড্রেইন, অপ্রতুল নিকাশী ব্যবস্থা এবং বর্জ্য নিষ্কাশণে গাফিলতির অভিযোগ জানান মুখ্যমন্ত্রীকে৷ এই বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী এলাকাবাসীকে আস্বাস দেন৷ তিনি বলেন, বনমালীপুর এলাকার জল নিষ্কাশনি ব্যবস্থাকে উন্নত ও আধুনিক করে তুলতে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ বৃষ্টি থামলেই এর কাজ শুরু হবে৷ অতীতে বনমালীপুর এলাকার জন্য এভাবে টাকা বরাদ্দ করা হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন৷ তিনি জানান, বনমালীপুর সহ সমগ্র আগরতলাকে জলপ্লাবনের হাত থেকে বাঁচাতে পরিকল্পনা রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী জলপ্লাবিত এলাকার মানুষজনদের কাছে দ্রুত খাবার ও পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে প্রশাসনিক আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছেন৷ এছাড়াও জলমগ্ণ এলাকায় দুর্গত মানুষদের সহায়তায় নৌকা নামাতেও বলেছেন তিনি৷ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার জেলা শাসক সন্দীপ এন মাহাত্মে, সদর মহকুমা শাসক ও অন্যান্য প্রশাসনিক আধিকারিকগণ৷