বেইজিং, ২২ জুলাই: চীনে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপরে বিশাল একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে, যার ফলে ভারতীয় ভূখণ্ডে ব্যাপক পরিবেশগত এবং কৌশলগত উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। চীনের এই বিশাল উদ্যোগ ভারতের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং অঞ্চলে জলবিভ্রাট ও বন্যার আশঙ্কা তৈরি করেছে, যা স্থানীয় জনগণের জীবন ও সম্পত্তির জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
১৯ জুলাই, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭০ বিলিয়ন ডলারের এই বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রকল্পটি চীনের ইতিহাসের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্প হবে, যা থ্রি গর্জেস ড্যামের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীন সরকার এই প্রকল্পকে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক হিসেবে দেখতে চায়।
এই প্রকল্পটি ইয়ালং ঝাংবো নদীর উপর নির্মিত হবে, যা ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান উৎস। ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীখাতে পাঁচটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হবে, যার সম্ভাব্য উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০ গিগাওয়াট, যা থ্রি গর্জেস ড্যামের ক্ষমতার তিনগুণ। এটি চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে, তবে প্রকল্পটির জল সঞ্চয় ক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি।
এদিকে, ভারতের বিশেষজ্ঞরা এবং রাজনীতিকরা চীনের এই প্রকল্পটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষত, চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে আঞ্চলিক ভূখণ্ডে হুমকি বাড়তে পারে, যার প্রভাব ভারতীয় রাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষত আরুণাচল প্রদেশে অনুভূত হতে পারে।
অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্দু ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে, এই বাঁধটি যদি নির্মিত হয় এবং চীন হঠাৎ করে জলের প্রবাহ ছেড়ে দেয়, তবে সিয়াং অঞ্চলে তীব্র বন্যা ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে। তিনি বলেন, “এটি আমাদের গোটা সিয়াং অঞ্চলকে ধ্বংস করে ফেলবে। বিশেষভাবে, আদি উপজাতি এবং আশপাশের গোষ্ঠীগুলির জন্য এটি বিপর্যয়কর হতে পারে। তাদের জমি, সম্পত্তি, জীবন, সবকিছুই বিপদের সম্মুখীন হবে।”
ব্রহ্মপুত্র নদীর ৩০ শতাংশ জল চীন থেকে আসে, তবে ভারতের আঞ্চলিক এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ জল স্থানীয় বৃষ্টিপাত থেকে আসে। চীনের বাঁধ প্রকল্পের ফলে ভারতীয় ভূখণ্ডে জল প্রবাহের উপর চাপ পড়বে, এবং বিশেষ করে সিয়াং অঞ্চলটি এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চীনের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি শুধু আঞ্চলিক ভূখণ্ডের জন্য নয়, বরং ভারতের বৃহত্তর জলবিদ্যুৎ ক্ষেত্রের জন্যও হুমকি তৈরি করেছে। ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই দেশের মোট ১৩৩ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনার প্রায় অর্ধেক বিদ্যমান, যার মধ্যে ৫০ গিগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা শুধু অরুণাচল প্রদেশে রয়েছে। তবে চীনের বাঁধ প্রকল্পের ফলে ভারতে পরিকল্পিত অন্যান্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এছাড়া, চীনের বাঁধ প্রকল্পটি বৃহত্তর পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হতে পারে, যার ফলে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমনকি, এটি ওই এলাকার কৃষি, জলসম্পদ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে।
চীনের এই বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে। ভারত সরকার সিয়াং অঞ্চলে একটি ১১.২ গিগাওয়াট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টোরেজভিত্তিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, “আপার সিয়াং” নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রকল্পটি ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে এবং সিয়াং অঞ্চলের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এক ধরনের প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।
তবে, এই প্রকল্পের অগ্রগতি এখনও স্লো। গত তিন বছর ধরে প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যালোচনা ও স্থানীয় প্রতিবন্ধকতার কারণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত কাজ আটকে রয়েছে। স্থানীয় জনগণের উদ্বেগ এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতা প্রকল্পের বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা আশ্বস্ত করেছেন যে, “চীন যা কিছু করুক, ভারত পুরোপুরি প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই প্রকল্পের প্রতি খুবই সিরিয়াস, এবং শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।”
চীনের এই বাঁধ প্রকল্প ভারতের জন্য কেবল জলসম্পদের উপর প্রভাব ফেলছে না, বরং এটি ভারত-চীন সম্পর্কের উপরও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। দুই দেশের মধ্যে পূর্বে অশান্ত সম্পর্কের কারণে, এই বাঁধ নির্মাণ বিষয়টি দুই পক্ষের মধ্যে আরও বড় কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
ভারত সরকার আশাবাদী যে, “আপার সিয়াং” প্রকল্পটি চীনের প্রকল্পের প্রভাব মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে এবং দেশের জলবিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সম্ভাব্য বন্যা এবং জলবিভ্রাটের ঝুঁকি হ্রাস করবে।
চীনের এই প্রকল্পটি কেবল একটি অবকাঠামো উদ্যোগই নয়, বরং একটি বৃহত্তর কৌশলগত এবং পরিবেশগত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব শুধু জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং জনসংখ্যার উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তাই, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পটির বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

