সিডিএস অনিল চৌহানের হুঁশিয়ারি: ‘আগামীকালের যুদ্ধ আজকের প্রযুক্তিতে, গতকালের অস্ত্রে নয়’ — অপারেশন সিন্ধুর দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন

নয়াদিল্লি, ১৬ জুলাই: ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সামরিক কৌশলের সামনে এক নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দিয়ে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন—আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে পুরনো প্রযুক্তি আর নির্ভরযোগ্য নয়। তিনি বললেন, “আজকের যুদ্ধ লড়তে হবে আগামীকালের প্রযুক্তি দিয়ে। গতকালের অস্ত্র দিয়ে আজকের যুদ্ধ জেতা যায় না।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক ও আত্মনির্ভর করে তোলার তাগিদ দিলেন।

বুধবার নয়াদিল্লির মানেকশ চেন্টারে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মশালায় সিডিএস অনিল চৌহান একথা বলেন। কর্মশালাটির থিম ছিল: ‘বিদেশি মূল যন্ত্রাংশের স্থলে দেশীয় সমাধান—ইউএভি ও সি-ইউএএস প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার দিকচিহ্ন।’ এই কর্মশালাটি আয়োজন করে হেডকোয়ার্টার্স, ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা ও কৌশল সংক্রান্ত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর জয়েন্ট ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ।

সিডিএস চৌহান তাঁর বক্তব্যে সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিন্ধু’র উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান ২০২৫ সালের মে মাসে এই অভিযানের সময় অনেকগুলো অনার্মড ড্রোন এবং ‘লয়টার মিউনিশন’ ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তাদের মোকাবিলা করে সফলভাবে সবকটি ড্রোনকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। “তাদের কোনও ইউএভি ভারতের সামরিক বা বেসামরিক পরিকাঠামোতে কোনও ক্ষতি করতে পারেনি,” বলেন চৌহান।

তিনি আরও যোগ করেন, “এই ড্রোনগুলির একাংশকে সম্পূর্ণ বা প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যা আমাদের জন্য বিশ্লেষণ ও প্রতিরক্ষা উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠবে।”

সিডিএস বলেন, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ, যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাত বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘর্ষ, দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে ছোট এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা ড্রোন বড় বড় অস্ত্র বা প্ল্যাটফর্মকে অকার্যকর করে দিতে পারে। “ড্রোন আজ শুধু সম্ভাবনা নয়, বরং এক কঠিন বাস্তবতা। এদের উপস্থিতি কৌশলগত ভারসাম্যকে অপ্রত্যাশিতভাবে বদলে দিতে পারে,” মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, “ড্রোন যুদ্ধের এই অ্যাসিমেট্রিক প্রকৃতি বড় বড় যুদ্ধজাহাজ, এয়ারক্রাফট বা ট্যাঙ্কের মত প্ল্যাটফর্মকে দুর্বল করে ফেলছে। তাই এখন থেকে ড্রোন-বিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।”

চৌহান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেন, ভারত আর বিদেশি প্রযুক্তি বা বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভর করতে পারে না—বিশেষত ইউএভি বা কাউন্টার-ইউএএস প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। “আমরা যদি বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করি, তাহলে আমাদের প্রস্তুতি দুর্বল হয়ে পড়বে। উৎপাদন ব্যাহত হবে। রক্ষণাবেক্ষণ ও স্পেয়ার পার্টসের ঘাটতিতে যুদ্ধের সময় বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রয়োজনে, আমাদের ভূখণ্ডে ব্যবহারের উপযোগী আদিবাসী প্রযুক্তি গড়ে তুলতে হবে। শুধু আমদানি করে আধুনিক হওয়া যায় না। ভারতকে আত্মনির্ভর হতে হবে—এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।”

এই উচ্চপর্যায়ের কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনা, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা, ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীরা, প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রতিনিধিরা এবং নীতিনির্ধারকরা। আলোচনার মূল বিষয় ছিল—ইউএভি বা কাউন্টার-ইউএএস প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ বা উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলির দেশীয় বিকল্প কীভাবে তৈরি করা যায়।

কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল একটি সুসংহত কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতে ভারত ইউএভি বা কাউন্টার-ইউএএস প্রযুক্তিতে পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে।

সিডিএস চৌহান তাঁর বক্তব্যের উপসংহারে বলেন, “ড্রোন, এআই, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, কাইনেটিক ও নন-কাইনেটিক প্রতিরক্ষা—এই সবই আগামী দশকের যুদ্ধনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। আমরা যদি এই প্রযুক্তির উন্নয়ন নিজেদের হাতে নিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতের যুদ্ধে পিছিয়ে পড়ব।”

তিনি আশাবাদী, এই ধরনের কর্মশালা ও সম্মেলনের মাধ্যমে সরকার, সামরিক বাহিনী, শিল্প ও বিজ্ঞান জগত একসাথে কাজ করে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও আত্মনির্ভর করে তুলতে পারবে।