নয়াদিল্লি, ২৩ জুন : দেশের চারটি রাজ্যের পাঁচটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। তাতে, গুজরাতে আসনটি ধরে রাখা ছাড়া বিজেপি বিশেষ চমক পারেনি। গুজরাতে একটি আসনে আম আদমি পার্টির উত্থান হয়েছে। তেমনি বামেদের শক্ত ঘাঁটি নিলাম্বুরে কংগ্রেস ভাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূল আসন ধরে রেখেছে। অবশ্য, উপনির্বাচনের এই ফলাফল জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তেমন প্রভাব ফেলবে মনে করার কারণ নেই। কিন্তু, আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে বিধানসভা নির্বাচনে এই ফলাফল কিছুটা প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) কেরালার নিলামবুরে বড় জয় অর্জন করেছে, একই সাথে আম আদমি পার্টি (আাপ) গুজরাটের বিশবদর ও পাঞ্জাবের লুধিয়ানা ওয়েস্ট আসন জিতে বড় সাফল্য দেখিয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপি গুজরাটের কাদি আসনে বিশাল জয় লাভ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস কালিয়াগঞ্জে জয়ী হয়ে আসন ধরে রেখেছে।
নিলাম্বুর উপনির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ প্রার্থী আর্যাদান শওকত ১১,০৭৭ ভোটের ব্যবধানে বামপন্থী প্রার্থী এম স্বরাজকে পরাজিত করেছেন। শওকত পেয়েছেন ৭৭,৭৩৭ ভোট, যেখানে স্বরাজ পেয়েছেন ৬৬,৬৬০ ভোট। এই জয়কে কংগ্রেসের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, ঐতিহ্যগতভাবে নিলাম্বুর বামেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এছাড়াও, এই কেন্দ্রটি ওয়ানাড় লোকসভা আসনের অন্তর্গত, যেখানে সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা নিজে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। বাম-সমর্থিত স্বতন্ত্র বিধায়ক পি.ভি. আনোয়ার পদত্যাগ করায় আসনটি শূন্য হয়। পরে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন।
লুধিয়ানা ওয়েস্ট আসনে আম আদমি পার্টির প্রার্থী ও প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ সঞ্জীব অরোরা প্রায় ১০,০০০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এই আসনটি শূন্য হয়েছিল বর্তমান আপ বিধায়ক গুরপ্রীত বাসি গোগির অকালমৃত্যুর পর। কংগ্রেস প্রার্থী ভারত ভূষণ আশু দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং বিজেপি প্রার্থী জীবন গুপ্ত তৃতীয় হন। এই আসনে আপ শীর্ষ নেতৃত্ব—অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, এবং আতসী জোরালো প্রচার চালিয়েছিলেন।
বিশাভদর আসনে আপের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি গোপাল ইতালিয়া বিজেপির কিরীট পটেলকে ১৭৫৫৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। এই জয় আপের জন্য একটি বড় মাইলফলক, কারণ গুজরাট বরাবরই বিজেপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, কাদিতে বিজেপির রাজেন্দ্র চাভদা প্রায় ৩৯,৪৫২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এই আসনটি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত এবং ফেব্রুয়ারিতে বিজেপি বিধায়ক কারসন সোলাঙ্কির মৃত্যুর পর থেকে শূন্য ছিল। কংগ্রেস ও আপ যথাক্রমে রমেশ চাভদা ও জগদীশ চাভদাকে প্রার্থী করেছিল।
কালিগঞ্জ আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের আলিফা আহমেদ বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। এই আসনটি নদিয়া জেলার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস ও বিজেপি যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। ওই আসনে তৃণমূল ১০২১৭৯, বিজেপি ৫২৪২৪ এবং কংগ্রেস ২৮২৬২ ভোট পেয়েছে।
প্রসঙ্গত, কালিগঞ্জে তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদের বড় ব্যবধানে জয় শাসক দলের জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা ধরে রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত, যা তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও, কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ভোট ভাগাভাগি এবং তৃণমূলের কাছে তাদের পরাজয় রাজ্যের বিরোধীদলের দুর্বলতা ও বিভাজনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে বিজেপির প্রচার ও কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তাদের পিছিয়ে পড়া রাজনীতিতে তৃণমূলের আধিপত্যের প্রমাণ। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, এই জয় তৃণমূলের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মনোবল বাড়াবে এবং দলের উন্নয়নমুখী নীতির প্রতি ভোটারের আস্থা বাড়াবে। পাশাপাশি, বিরোধীদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হল, কালিয়াগঞ্জের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারের উচ্চ অংশগ্রহণ সত্ত্বেও তৃণমূল ধর্ম ও জাতি বিবেচনা না করে কাজ করার ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে, যা দলের বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পরিচয় দেয়। সার্বিকভাবে, কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের জয় পশ্চিমবঙ্গে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার পাশাপাশি আগামী বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বাভাস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা বিরোধীদল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
বিষাবাদর আসনে বিজেপি ২০০৭ সাল থেকে জয়ী হতে পারেনি, ফলে ১৮ বছরের এই জয়ের অভাব ছিল দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আপের গোপাল ইতালিয়া ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। ইতালিয়া ২০১৫ সালের পাতিদার আন্দোলনের সময় রাজ্যে পরিচিতি লাভ করেন, যা তাকে স্থানীয় জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে এবং ভোটারদের সমর্থন পেতে সাহায্য করে। বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন ও দুর্বলতা আপের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে যখন আগের আপ বিধায়ক ভূপেন্দ্র ভায়ানী বিজেপিতে যোগদান করেন, তখন আপ নতুন শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। আপের জনমুখী নীতি ও দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা গোপাল ইতালিয়ার বিজয়ের পেছনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সব কারণ মিলিয়ে গুজরাটের বিষাবাদরে আপের গোপাল ইতালিয়ার বিজয় একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই নির্বাচনী ফলাফলগুলি মূলত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিক নির্দেশ করছে। বিশেষ করে গুজরাট ও কেরালার মতো রাজ্যে বিজেপির পারফরম্যান্স এবং পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এই ফলাফলগুলি তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও কৌশল পর্যালোচনার সুযোগ দিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেরালার নিলামবুরে কংগ্রেসের জয় ও গুজরাটের কাদিতে বিজেপির বিশাল জয় তাদের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলেই দাবি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের। এদিকে, কেরালার নিলামবুরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফের জয় তাদের পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাদের অবস্থান শক্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ওয়ায়ানাড এলাকা হওয়ায় এই জয় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, তা বলাইবাহুল্য।
গুজরাট ও পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে আপের সাফল্য তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর পাশাপাশি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের এই পারফরম্যান্স ভবিষ্যতে রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা প্রসারের সম্ভাবনা নির্দেশ করছে, এমনটা অনেকেই মনে করছেন। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের জয় আগামী বছর রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য দলের শক্ত অবস্থানের প্রমাণ এবং বিরোধীদলের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। সার্বিকভাবে, এই ফলাফলগুলি ভারতের রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা ও কৌশলগত অবস্থানের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।

