ওয়াশিংটন, ১৪ ডিসেম্বর: প্রখ্যাত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন চিকিৎসক ও সমাজনেতা ডা. ভরত বারাই সতর্ক করে বলেছেন, সাম্প্রতিক শুল্কনীতি থেকে ওয়াশিংটন সরে না এলে আগামী দিনে ভারত–মার্কিন সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের জন্য চাপের মুখে থাকতে পারে। তাঁর মতে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জ্বালানি বাস্তবতার নিরিখে ভারতকে অন্যায্যভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ডা. বারাই বলেন, একাধিক প্রশাসনের আমলে গড়ে ওঠা ভারত–মার্কিন সম্পর্কের ইতিবাচক গতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর ধাক্কা খেয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত এই সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি স্বীকার করেন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। তবে তাঁর মতে, সেই ঘাটতি মোকাবিলায় ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক কৌশল নেওয়া উচিত ছিল। ডা. বারাই বলেন, “শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য শুল্ক আরোপ এক বিষয়, কিন্তু হঠাৎ করে ২৫ শতাংশ তথাকথিত পারস্পরিক শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এই হার ১৫ শতাংশের কাছাকাছি হওয়াই যুক্তিসঙ্গত ছিল।”
রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির কারণে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়েও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েও ডা. বারাই বলেন, এই নীতিতে ভারত কার্যত “নির্দোষ বাইস্ট্যান্ডার”-এ পরিণত হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ভারত অপেক্ষা বেশি পরিমাণে রুশ তেল আমদানি করলেও চীনকে একইভাবে শাস্তি দেওয়া হয়নি। “চীনের হাতে ‘ট্রাম্প কার্ড’ রয়েছে—রেয়ার আর্থ ধাতু। বৈদ্যুতিক গাড়ি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এমনকি আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরিতেও আমেরিকা ও ইউরোপ চীনের উপর নির্ভরশীল,” বলেন ডা. বারাই। তিনি আরও জানান, বহু ইউরোপীয় দেশ এখনও রুশ জ্বালানি আমদানি করলেও তাদের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়নি।
ডা. বারাই প্রশ্ন তোলেন, “চীন যেখানে ৪৭ শতাংশ শুল্কে রয়েছে, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ যেখানে প্রায় ১৫ শতাংশে, সেখানে কেন শুধুমাত্র ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানো হবে? হাঙ্গেরি বা স্লোভেনিয়ার মতো দেশগুলির বিরুদ্ধে তো কোনও অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
এই শুল্কনীতির নেপথ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, অভিবাসন নীতির কট্টর সমর্থক স্টিফেন মিলার ও বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এই সিদ্ধান্তগুলির মূল চালিকাশক্তি। তাঁর দাবি, বহু কংগ্রেসম্যান ও সেনেটর ব্যক্তিগতভাবে এই নীতির বিরোধিতা করলেও ট্রাম্পের প্রতিশোধের আশঙ্কায় প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।
ডা. বারাই জানান, নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচন এবং মায়ামির মেয়র নির্বাচনেও জনমত বদলের ইঙ্গিত মিলেছে। “এই নীতিগুলি ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কংগ্রেস নয়, ওভাল অফিসে বসে তিনজনের সিদ্ধান্তেই এগুলি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি। তাঁর আশা, ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্ট শুল্ক আরোপের ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতেই থাকা উচিত বলে রায় দেবে।
ভারত–মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ডা. বারাই বলেন, অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার না হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কার্যত স্থবির থাকতে পারে। তিনি জানান, রিলায়েন্সসহ কিছু ভারতীয় সংস্থা নির্দিষ্ট রুশ সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞার পর তেল আমদানি কমিয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে এই উৎস থেকে সরে আসা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।
“১৪০ কোটি মানুষের দেশের জন্য নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী জ্বালানির উৎস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিনি। তাঁর কথায়, ভারত মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করে, বাকি অংশ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার প্রশংসা করে ডা. বারাই বলেন, তিনি ভারতের জাতীয় স্বার্থেই কাজ করছেন এবং ওয়াশিংটনের চাপ অত্যন্ত কূটনৈতিক ও শালীনভাবে মোকাবিলা করছেন। “তিনি খুব ভদ্র ও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। ভারতের মানুষের জন্য যা ভালো, সেটাই করছেন,” বলেন ডা. বারাই।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে বলেও মত তাঁর। ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার, ব্রিটেনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, আফ্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া প্রায় সর্বত্রই ভারতের প্রতি সম্মান আগের চেয়ে বেড়েছে।”
_____

