নয়াদিল্লি, ২৭ অক্টোবর: ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম স্বদেশী বিমানবাহী রণতরী (আইএসি-১) ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ আত্মনির্ভর ভারত গড়ার শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত, যা দেশটির সমুদ্রের ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
আইএনএস বিক্রান্তের নির্মাণের সূচনা হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোচি শিপইয়ার্ড লিমিটেড এ, এবং এটি ২০২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীতে কমিশন করা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ডিজাইন ব্যুরো এর ডিজাইন করা এই রণতরী ভারতীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের এক অভূতপূর্ব সাফল্য।
আইএনএস বিক্রান্তের নামটি রাখা হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম বিমানবাহী রণতরী, আইএনএস বিক্রান্ত (আর১১)-এর সম্মানে, যেটি ১৯৯৭ সালে পরিষেবা থেকে অবসর নেওয়া হয়েছিল। প্রাক্তন আইএনএস বিক্রান্ত ১৯৬১ সালের গোয়া মুক্তি অভিযানে এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমান আইএনএস বিক্রান্ত (আইএসি-১) এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর স্বদেশী সক্ষমতা ও উন্নত জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আইএনএস বিক্রান্ত, ভারতের প্রথম স্বদেশী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ (আইএসি-১), দেশের সামরিক শক্তি এবং আত্মনির্ভরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এর দৈর্ঘ্য ২৬২.৫ মিটার এবং প্রস্থ ৬১.৬ মিটার, যার মোট ওজন প্রায় ৪৫,০০০ টন। এটি চারটি গ্যাস টার্বাইন দ্বারা চালিত, যা মোট ৮৮ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে এবং সর্বোচ্চ ২৮ নট গতি অর্জন করতে সক্ষম। এই জাহাজে ১,৬০০ কর্মী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এবং এর মধ্যে ২,২০০ কেবিন রয়েছে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শট টেক-অফ বাট অ্যারেস্টেড রিকভারি সিস্টেম, যার মাধ্যমে এটি স্কী-জাম্প ব্যবহার করে বিমান উড়ান এবং অ্যারেস্টর তারের সাহায্যে অবতরণ করতে পারে। এটি মিগ-২৯কে, কামোভ-৩১, এমএইচ-৬০আর, মিগ-২৯কেএউবি, চেতক এবং আলহ ধ্রুবসহ মোট ৩০টি বিমান পরিচালনা করতে সক্ষম।
আইএনএস বিক্রান্ত তার পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২১ সালের আগস্টে এটি প্রথম সমুদ্র পরীক্ষায় অংশ নেয়, যেখানে এর প্রণোদনা, নেভিগেশন এবং অস্ত্র ব্যবস্থাগুলি সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়। এরপর, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আইএনএস বিক্রান্তে প্রথমবারের মতো এলসিএ (নৌ) এবং মিগ-২৯কে জেটের অবতরণ সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ২০২৩ সালের মে মাসে, এটি রাত্রিকালীন কঠিন পরিবেশে সফলভাবে অবতরণ পরিচালনা করে, যা তার উন্নত প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রমাণ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আইএনএস বিক্রান্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বিপক্ষীয় সমুদ্র অনুশীলন “মিলন ২৪” এ অংশগ্রহণ করে, যেখানে ৬টি মহাদেশের ৩৬টি যুদ্ধজাহাজ, ২টি সাবমেরিন, ৫৫টি বিমান এবং ৪৭টি দেশ অংশগ্রহণ করে।
আইএনএস বিক্রান্ত শুধু ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি অনন্য অবদান নয়, এটি ভারতের আত্মনির্ভরতা এবং আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তি হিসেবে নতুন একটি পরিচিতি সৃষ্টি করেছে।
আইএনএস বিক্রান্তের নির্মাণে ৭৬ শতাংশ উপাদান স্বদেশী এবং এতে প্রায় ৩০,০০০ টন বিশেষ স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে, যা স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (এসইএল) থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এটির নির্মাণে ৫৫০ এরও বেশি অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার এবং ১০০-এরও বেশি ক্ষুদ্র, মাইক্রো, ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অংশগ্রহণ করেছে। কোচি শিপইয়ার্ড লিমিটেডে প্রায় ২,০০০ কর্মী এবং অন্যান্য সরবরাহকারী শিল্পে ১২,৫০০ কর্মীকে কর্মসংস্থান হয়েছে।
আইএনএস বিক্রান্ত শুধু যুদ্ধের জন্যই নয়, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ উদ্ধার অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় ৫,০০০ পরিবারের জন্য যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম। এছাড়াও, এটি সংকটপূর্ণ অঞ্চলে মোবাইল কমান্ড সেন্টার এবং তেল সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করতে পারে।
আইএনএস বিক্রান্তের নির্মাণ ভারতের আত্মনির্ভরতা এবং “মেক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের সাফল্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর নির্মাণ ও প্রযুক্তি ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তিশালী সমুদ্রবাহিনীতে পরিণত হওয়া এবং ভবিষ্যতে ভারতের সমুদ্র শক্তির শক্তিশালীীকরণে একটি মাইলফলক।
আইএনএস বিক্রান্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি শক্তিশালী অস্ত্র, যা দেশের সামরিক সক্ষমতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং আত্মনির্ভরতার মূর্ত প্রতীক। এটি শুধু ভারতীয় সমুদ্র শক্তির উন্নতি নয়, বরং ভবিষ্যতে ভারতকে বিশ্বে এক শক্তিশালী সামরিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

