দেরাদুনে ক্লাউডবার্স্টে তাণ্ডব, ট্যাপকেশ্বর মন্দির জলমগ্ন, ২০০ ছাত্র উদ্ধার; উত্তরাখণ্ডে বিপর্যয়ের চিত্র ভয়াবহ

দেরাদুন, ১৬ সেপ্টেম্বর : উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে রাতারাতি প্রকৃতির ভয়ংকর রূপ দেখা গেল। সোমবার রাতভর টানা ভারী বৃষ্টিপাতের জেরে শহরের উপকণ্ঠে ঘটে গেল এক ভয়াবহ ক্লাউডবার্স্ট, যার ফলে ট্যামসা নদীর জলস্তর হঠাৎ করে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। নদীর রূপ এমন ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, শহরের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র, ঐতিহাসিক ট্যাপকেশ্বর মহাদেব মন্দির সম্পূর্ণভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত দুই ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে প্রশাসন।

প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি শহরের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মন্দিরের আশপাশের দোকান, রাস্তা ও পার্ক করা গাড়ি পানির তোড়ে ভেসে গিয়েছে। জেলাজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে পাউনদা অঞ্চলে অবস্থিত দেবভূমি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র ক্যাম্পাসে, যেখানে অতিরিক্ত জল জমে ২০০ ছাত্র আটকে পড়েন। SDRF-এর একাধিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার কাজ চালায় এবং সকল ছাত্রকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়। এসডিআরএফ-এর বিবৃতিতে জানানো হয়, “আমাদের দল সময়মতো পৌঁছে পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল ছাত্রকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করে। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হলেও উদ্ধার কাজ সফল হয়েছে।”

ঘটনার খবর পেয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক আধিকারিকরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাভিন বনসাল ও এসডিএম কুমকুম জোশী ঘটনাস্থলে পৌঁছে ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনা করেন এবং উদ্ধার কাজের তদারকি করেন। একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী মঙ্গলবার ভোরে স্বয়ং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন এবং সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, “সাহসত্রধারা, মালদেবতা, কেশরওয়ালা ও রাইপুর এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১০০ মিটার রাস্তা ধুয়ে গেছে, বহু বাড়ি ও সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তবে প্রশাসন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছে।” তিনি আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজ সকালে আমাকে ফোন করে বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন এবং রাজ্যকে সমস্তরকম সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।”

এনডিআরএফ-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডেন্ট অজয় পান্ত জানান, “ক্লাউডবার্স্টের কারণে পাহাড় থেকে এখনও মাটি, পাথর ও জল নেমে আসছে, তাই সন্ধ্যার পর তল্লাশি অভিযান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনজন ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।”

সাহসত্রধারা নদীর জল বাড়তে বাড়তে শহরের মূল বাজার এলাকায় ঢুকে পড়ে, যার ফলে অনেক দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরের একাধিক রাস্তায় ধস নেমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাইপুর-মালদেবতা রোড সম্পূর্ণ ধুয়ে গেছে বলে জানা গেছে। একাধিক গ্রামের সঙ্গে সড়ক সংযোগ ভেঙে পড়েছে। রেললাইনও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়েছে।

দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকাগুলিতেও নদীর জল ঢুকে পড়ায় ঋষিকেশ, মালদেবতা, সাহসত্রধারা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করছে।

এদিকে, উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও একইসঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অব্যাহত। হিমাচল প্রদেশের কাংড়া জেলায়, ২০ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান অতিবৃষ্টির ফলে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, এবং ৬০৩ কোটিরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার ডেপুটি কমিশনার হেমরাজ বাইরওয়া। ১৮০টি কাঁচা বাড়ি ও ২৭টি পাকা বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এছাড়া ১,৩৮৮টি গোয়ালঘর, ৭৪টি শ্রমিক শেড, রান্নাঘর, বাথরুম এবং ৩৩টি দোকান ধ্বংস হয়েছে।

শিমলায়, মাত্র ১২ ঘণ্টায় ১৪১ মিমি বৃষ্টিপাত হওয়ায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং ভূমিধসের ফলে প্রধান রাস্তাগুলি বন্ধ হয়ে পড়েছে। স্কুলে যেতে পারছে না অনেক ছাত্রছাত্রী। রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী মুকেশ অগ্নিহোত্রী, যিনি পরিবহণ দফতরের দায়িত্বে আছেন, জানিয়েছেন যে ধরমপুর বাসস্ট্যান্ড, এইচআরটিসি-র বহু বাস ও দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার সম্মিলিতভাবে বিপর্যয় মোকাবিলায় কাজ করে চলেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের উদ্দেশে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে এবং পাহাড়ি এলাকা ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে জনসাধারণকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে।

উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচলপ্রদেশের এই দুর্যোগ ফের প্রশ্ন তোলে — জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও পাহাড়ি অঞ্চলে অপরিকল্পিত নির্মাণ এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের ফলে কতটা ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে এই পাহাড়ি রাজ্যগুলির পরিবেশ। ভবিষ্যতের জন্য আরও সতর্কতা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা যে জরুরি, এই দুর্যোগ তা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।