সারাদেশজুড়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া: প্রবল বর্ষণে বিপর্যস্ত জনজীবন, নদীর জলস্তর বৃদ্ধি, ভূমিধস ও বন্যা পরিস্থিতিতে জারি সতর্কতা

নয়াদিল্লি, ১৮ আগস্ট : পাঞ্জাব রাজ্যে রবি ও বিয়াস নদীর জলস্তর বিপজ্জনক হারে বেড়ে যাওয়ার ফলে একাধিক জেলা এখন জলমগ্ন। হিমাচল প্রদেশে টানা বৃষ্টিপাত এবং জম্মু অঞ্চলে মেঘভাঙা বৃষ্টির কারণে নদীগুলির জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পাঠানকোট, গুরুদাসপুর, কপুরথলা, হোশিয়ারপুর, ফাজিলকা ও ফিরোজপুর জেলাগুলিতে। বিশেষ করে কপুরথলা ও হোশিয়ারপুরের প্রায় ২০টিরও বেশি গ্রাম এবং পাঠানকোট জেলার প্রায় ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে। শত শত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রী বরিন্দর কুমার গোয়েল জানান, প্রায় ১৪,২০০ একর কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে ধানখেত সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের ২৪ ঘণ্টার নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি, স্বাস্থ্য দফতর থেকে জানানো হয়েছে, রাজ্যব্যাপী ২০০০টিরও বেশি হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সম্ভাব্য মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডঃ বালবীর সিং জানান, ইতিমধ্যে ৪৩৮টি র‍্যাপিড রেসপন্স টিম, ৩২৩টি মোবাইল মেডিক্যাল টিম এবং ১৭২টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন করা হয়েছে। কপুরথলা ও হোশিয়ারপুরে স্বাস্থ্য শিবির খোলা হয়েছে এবং জলে সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জনগণকে সরকারের ১০৪ নম্বর হেল্পলাইনে যোগাযোগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, কোকন ও পশ্চিম ঘাট অঞ্চলে টানা তিনদিনের প্রবল বৃষ্টিপাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। মুম্বাই মহানগর এলাকা, রায়গড়, রত্নাগিরি, সাতারা, কোলহাপুর জেলাগুলিতে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার হওয়ায় জেলেদের সমুদ্রে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং এনডিআরএফ দলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বিমান যাত্রার আগে ফ্লাইটের সময়সূচি যাচাই করে নেওয়া উচিত, কারণ টানা বৃষ্টির কারণে বিমান চলাচলে প্রভাব পড়েছে।

গোয়ায় প্রবল বর্ষণে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত। আগামী গনেশ চতুর্থী উৎসবের কেনাকাটায় ভাটা পড়েছে। ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে কিছু এলাকায় ১০০ ইঞ্চির বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমি বৃষ্টি ইতিমধ্যেই ৯০ ইঞ্চি ছাড়িয়েছে। ভালপয়, ধারবন্দোরা, কেপেম এবং সাঙ্গুয়েম অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আইএমডি রাজ্যের জন্য অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি করেছে এবং জনগণকে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে আগামীকাল পর্যন্ত টানা ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। জম্মু, রিয়াসি, উদমপুর, রাজৌরি, পুঞ্চ, সাম্বা, কাঠুয়া প্রভৃতি এলাকায় মেঘভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। দোডা, কিশ্তওয়ার ও রামবানের কিছু জায়গায়ও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। জম্মু বিভাগের সমস্ত স্কুল আজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বৃষ্টির ফলে ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ল্যান্ডস্লাইড, মাডস্লাইড এবং শুটিং স্টোন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। জনগণকে নদী, খাল এবং পাহাড়ি এলাকার কাছাকাছি না যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। পর্যটকদেরও সতর্কভাবে পরিকল্পনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম-মধ্য ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে একটি নিম্নচাপ সিস্টেম তৈরি হয়েছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম, অনাকাপল্লে, কাকিনাড়া, গুন্টুরসহ একাধিক জেলায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সেখানকার বহু স্কুল ও কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

ওড়িশার মালকানগিরিতে জাতীয় সড়ক এবং ব্রিজগুলি জলের নিচে চলে গেছে। ঘরবাড়িতে জল ঢুকে পড়েছে, প্রশাসন ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে ব্যস্ত। রাজধানী ভুবনেশ্বরে টানা বৃষ্টি ও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির কারণে যানচলাচল বিঘ্নিত হয়েছে। আবহাওয়া দফতর দক্ষিণ ওড়িশার কালাহান্ডি, রায়গড়া, গজপতি, গঞ্জাম, নুয়াপাড়া সহ একাধিক জেলার জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।

হিমাচল প্রদেশে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ছিল মান্ডি জেলার কাটুয়ালায় (১২০ মিমি) এবং কাংড়ার নাগরোটা সুরিয়ানে (১১০ মিমি)। বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের কারণে তিনটি জাতীয় সড়কসহ বহু রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চলতি বর্ষায় রাজ্যে এখন পর্যন্ত ২৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন ৩৭ জন। বৃষ্টির প্রভাব এতটাই প্রবল যে, এখনও বহু এলাকায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

দিল্লিতে যমুনা নদীর জলস্তর হঠাৎ করে বেড়ে গিয়ে ২০৫.২৪ মিটারে পৌঁছেছে, যা সতর্কতা সীমা ২০৪.৫ মিটারের ওপরে। হথিনিকুন্ড ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার ফলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সারাদেশজুড়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর জলস্তর বৃদ্ধি, ভূমিধস, মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং প্লাবনের মতো বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য প্রশাসন ত্রাণ, উদ্ধার এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা জোরদার করার চেষ্টা করছে। তবে সাধারণ নাগরিকদেরও সতর্ক থাকতে এবং প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।