ট্রাম্পের ৫০% শুল্ক আরোপ: ৯০টি দেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আক্রমণ, ভারতসহ বিশ্বব্যাপী বড় প্রভাব

ওয়াশিংটন, ৭ আগস্ট : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশের উপর ৫০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছেন, যা মার্কিন বাণিজ্য নীতিতে একটি বড় ধরনের উল্টো ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প নিজেই তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যাল এ একটি পোস্টে জানান, “এটি মধ্যরাত্রি! বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার শুল্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাহিত হচ্ছে!” এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

আগের দিন, বুধবার, ট্রাম্প তার এক পোস্টে বলেন, “প্রতিদানমূলক শুল্ক আজ মধ্যরাতে কার্যকর হবে! বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকানো দেশগুলো থেকে শুল্কে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাহিত হবে।” এর মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং এর শুল্ক নীতির কড়া অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

ভারত, এই বাণিজ্য আক্রমণের প্রথম দফায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হলেও, বুধবার ট্রাম্প এই শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০% করার ঘোষণা দেন। এই ২৫% অতিরিক্ত শুল্ক ২১ দিন পর কার্যকর হবে। সাদা বাড়ির এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক ভারতীয় পণ্যের উপর আরোপ করবে বিশেষভাবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে। এই পদক্ষেপটি রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জরুরি অবস্থার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এছাড়া, ট্রাম্প একাধিক মার্কিন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এই শুল্ক কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বর্তমানে, মার্কিন বাণিজ্যিক নীতি অনুযায়ী, আমেরিকায় পণ্য আমদানি করার জন্য একটি ন্যূনতম ১০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তবে ট্রাম্পের নতুন ঘোষণার ফলে তা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন, বিভিন্ন দেশের জন্য শুল্কের হার পৃথক পৃথক হবে। কিছু দেশের উপর সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যেমন ব্রাজিল (৫০%), লাওস (৪০%), মিয়ানমার (৪০%), সুইজারল্যান্ড (৩৯%), ইরাক (৩৫%) এবং সার্বিয়া (৩৫%)। ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হবে। ভিয়েতনাম (২০%), তাইওয়ান (২০%) এবং থাইল্যান্ড (১৯%) এর শুল্কের হারও যথাক্রমে ২০%, ২০%, এবং ১৯%।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া শুল্ক বৃদ্ধির শিকার হয়েছে, তবে কিছু দেশ যেমন যুক্তরাজ্য তাদের শুল্ক কমানোর জন্য আলোচনা চালিয়ে গেছে।

এছাড়া, ট্রাম্প আরও ঘোষণা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ আমদানির উপর ১০০% শুল্ক আরোপ করবে। তবে, একটি বড় এক্সেম্পশন রাখা হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনকারী অথবা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোম্পানিগুলি এই শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবে। ট্রাম্প এই ঘোষণাটি ওয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সামনে জানিয়ে বলেন, “যে কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন করবে, তাদের উপর শুল্ক আরোপ করা হবে না। তবে, যদি তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং উৎপাদন শুরু না করে, তবে পরবর্তীতে তাদের শুল্ক বাড়ানো হবে।”

এই পদক্ষেপে কিছু বড় প্রযুক্তি কোম্পানির উপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপল ঘোষণা করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রে আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ট্রাম্প বলেন, “অ্যাপল যদি তাদের উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তবে তারা এই শুল্ক থেকে মুক্ত থাকবে।” তবে, তার মন্তব্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে, কারণ এখনো কিভাবে এই শুল্ক বাস্তবায়িত হবে এবং এর সঠিক প্রভাব কী হবে, তা স্পষ্ট হয়নি।

এছাড়া, বিভিন্ন দেশগুলোর উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের হার এখন স্পষ্ট হয়েছে, এবং এতে দেখা যাচ্ছে যে বেশিরভাগ দেশই শুল্ক বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে, যদিও কিছু দেশের শুল্ক হার কম রাখা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, ভিয়েতনামের জন্য শুল্ক হার ২০%, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের জন্য শুল্ক ২০% এবং ১৯% নির্ধারিত হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের উপর শুল্ক ৩৯%, ব্রাজিলের উপর ৫০% এবং লাওসের উপর ৪০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, আরও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে শুল্কের হার ১৫% থেকে ২৫% পর্যন্ত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

কানাডার উপর শুল্ক ২৫% থেকে ৩৫% বাড়ানো হয়েছে, কারণ ট্রাম্প কানাডাকে মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে, কানাডার বেশিরভাগ পণ্য এখনও ইউএসএমসিএ চুক্তির আওতায় সুরক্ষিত থাকবে।

মেক্সিকোর পণ্যের উপর শুল্ক সাময়িকভাবে ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে, কারণ দুই দেশের মধ্যে আলোচনার জন্য কিছু সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ফলে অনেক দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুনভাবে রূপ নেবে। বিশেষত, ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, এবং অন্যান্য প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই শুল্ক আরও কঠিন হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শুল্ক নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে, যেখানে অনেক দেশ নিজেদের বাণিজ্য কৌশল পুনরায় সাজাতে বাধ্য হবে।

এখন দেখার বিষয়, বিশ্ব অর্থনীতি এবং মার্কিন-অন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কীভাবে প্রভাবিত হয় এবং অন্যান্য দেশগুলো কীভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়।