মিয়ানমারের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মাইন্ট সোয়ে ৭৪ বছর বয়সে মারা গেছেন, সামরিক জান্তা মৃত্যু নিশ্চিত করেছে

নেপিডো,৭ আগস্ট : মিয়ানমারের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মাইন্ট সোয়ে, যিনি ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর কার্যত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, দীর্ঘ অসুস্থতার পর ৭৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, সামরিক বাহিনী তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এবং জানিয়েছে যে, মাইন্ট সোয়ে ৮:২৮ মিনিটে স্থানীয় সময় নেপিডো-এর একটি সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তিনি নিউরোলজিক্যাল এবং নিউরোডিজেনারেটিভ অসুস্থতায় আক্রান্ত ছিলেন, যা দীর্ঘ সময় ধরে তাকে ভুগিয়েছে।

মাইন্ট সোয়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং তার শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটেছিল। এক বছর ধরে তিনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং গত বছর এপ্রিল মাসে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন, এরপর তাকে নেপিডো-এর একটি সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সামরিক বাহিনী জানায়, মাইন্ট সোয়ে দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, মানসিক অবনতি, ক্ষুধামন্দা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন, যা তার দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। সামরিক বাহিনী জানায়, তার মৃত্যুটি একটি দীর্ঘ অসুস্থতার ফলশ্রুতি, বিশেষ করে তার নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে।

এছাড়া, গত জুলাই মাসে সামরিক বাহিনীর একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, মাইন্ট সোয়ে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি এবং অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল রোগে আক্রান্ত, যা তার শারীরিক সক্ষমতা ও ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

মাইন্ট সোয়ে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী তখনই দেশের নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে এবং প্রেসিডেন্ট উইন মাইন্ট ও দেশের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী আং সান সু চি গ্রেফতার করে। মাইন্ট সোয়ে তখন প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে, তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। অনেক আইনজ্ঞের মতে, উইন মাইন্টের পদত্যাগ বা অসুস্থতার ঘোষণা ছাড়াই মাইন্ট সোয়ের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়া বৈধ ছিল না।

তবে, মাইন্ট সোয়ে’র এই পদ গ্রহণে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছিল। তার প্রেসিডেন্টশিপের সময়, মূল কার্যক্রম ছিল একেবারে প্রতীকী এবং জরুরি অবস্থা বাড়ানোর জন্য সরকারি আদেশ জারি করাই ছিল তার প্রধান দায়িত্ব। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে, যিনি ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার শাসন করছেন।

মাইন্ট সোয়ে ছিলেন একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা এবং সাবেক সামরিক জান্তার নেতা থান শ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তিনি ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের চিফ মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে সাফ্রন বিপ্লব নামে পরিচিত এক প্রতিবাদ আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছিল, যেখানে মঠভিত্তিক বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।

মাইন্ট সোয়ে তার সামরিক জীবনে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দমন-পীড়নে জড়িত ছিলেন, বিশেষত ২০০২ সালে প্রাক্তন শাসক নে উইনের পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার এবং ২০০৪ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খিন নিউন্টকে আটক করার ঘটনায়। এসব পদক্ষেপ তাকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ভেতরে এক শক্তিশালী অবস্থান এনে দেয় এবং পরবর্তীতে তিনি মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

মাইন্ট সোয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠবে। দেশটি ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং জনগণের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। সামরিক জান্তা, যার হাতে এখন পুরো দেশের ক্ষমতা, ২০২৫ অথবা ২০২৬ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তবে তা এখনও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।

মাইন্ট সোয়ে মারা যাওয়ার সময় মিয়ানমারকে শাসন করছেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার, মিন অং হ্লাইং। মাইন্ট সোয়ে’র মৃত্যুর ফলে সামরিক সরকারের মধ্যে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসবে কিনা, সেটি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে নজর রাখা হচ্ছে।

মাইন্ট সোয়ে মৃত্যুর পর তার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। তার শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হবে, যদিও তার মৃত্যুর পর ঠিক কী সময়ে তা সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা করা হয়নি।

মিয়ানমারে চলমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং শাসন ব্যবস্থার অনিশ্চয়তার মাঝে মাইন্ট সোয়ের মৃত্যু একটি নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে, তবে পরিস্থিতি কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে।