২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সাইবার প্রতারণায় ভারতীয়দের ক্ষতি ৭,০০০ কোটি টাকা, মূল হোতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা নিয়ন্ত্রিত চক্র

নয়াদিল্লি, ১৫ জুলাই : ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ভারতে সাইবার প্রতারণার মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, মাত্র পাঁচ মাসেই ভারতীয় নাগরিকরা প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা হারিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কো-অর্ডিনেশন সেন্টার -এর রিপোর্ট অনুসারে, এই প্রতারণাগুলির মূল পরিকল্পনাকারী ও কার্যনির্বাহী গোষ্ঠীগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ—কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ডে সক্রিয়, এবং তাদের বেশিরভাগই চীনা নিয়ন্ত্রণাধীন সাইবার অপরাধ চক্র।

এই চক্রগুলি শুধুমাত্র ভারতে নয়, বরং বিশ্বব্যাপী প্রতারণার জাল বিছিয়েছে। তবে I4C-এর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, সম্প্রতি ভারতীয়দের লক্ষ্য করে প্রতারণার হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে, যার মাসিক গড় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা।

সরকারি তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে ক্ষতি হয়েছে ১,১৯২ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৫১ কোটি, মার্চে ১,০০০ কোটি, এপ্রিল মাসে ৭৩১ কোটি এবং মে মাসে ৯৯৯ কোটি টাকা। এই হিসেবে, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬,৮৭৩ কোটি। তবে বিভিন্ন রাজ্যে নতুন রিপোর্ট আসায় অনুমান করা হচ্ছে, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ ₹৭,০০০ কোটিরও বেশি।

I4C-এর তদন্ত অনুযায়ী, এই সাইবার প্রতারক চক্রগুলি অত্যন্ত নিরাপত্তাবেষ্টিত কম্পাউন্ডে প্রতারণা চালাচ্ছে, যেগুলি মূলত চীন দ্বারা পরিচালিত। এই কেন্দ্রগুলিতে পাচার করে আনা হয় ভারত, আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার অসংখ্য নাগরিককে। তাদের মোবাইল, পাসপোর্ট ও চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে রেখে জোরপূর্বক সাইবার অপরাধে যুক্ত করা হয়।

ভারত সরকারের কাছে আসা উদ্ধৃত তথ্য অনুযায়ী, কম্বোডিয়ায় অন্তত ৪৫টি, লাওসে ৫টি এবং মায়ানমারে ১টি বড় প্রতারণা কম্পাউন্ড চিহ্নিত হয়েছে। এই কম্পাউন্ডগুলির ভূ-অবস্থান চিহ্নিত করে কম্বোডিয়ান প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত সরকার।

তদন্তে উঠে এসেছে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পরিচালিত চক্রগুলি মূলত তিন ধরনের সাইবার প্রতারণা কৌশল ব্যবহার করছে—স্টক ট্রেডিং ও ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যাম, ডিজিটাল অ্যারেস্ট স্ক্যাম এবং টাস্ক বেসড স্ক্যাম। স্টক ট্রেডিং ও ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যামের ক্ষেত্রে প্রতারকরা বিভিন্ন ভুয়ো অ্যাপ, ওয়েবসাইট এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উচ্চ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে, এবং পরে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করে। ডিজিটাল অ্যারেস্ট স্ক্যামে ভুয়া পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তার পরিচয়ে ফোন করে জানানো হয় যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে এবং তা থেকে মুক্তি পেতে জরুরি ভিত্তিতে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে, না হলে তাকে গ্রেফতার করা হবে—এই ভয় দেখিয়েই অর্থ আদায় করা হয়। আর টাস্ক বেসড স্ক্যামের ক্ষেত্রে, সহজ কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যেমন কোনো অ্যাপ রেট করা বা ছোট ছোট টাস্ক সম্পাদন করা, এবং ধাপে ধাপে ‘নিবেশের’ নামে টাকা নেওয়া হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থ ফেরত দেওয়া হয় না। এই প্রতারণা কৌশলগুলির মাধ্যমে প্রতারক চক্রগুলি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আর্থিক নিরাপত্তার উপর মারাত্মক আঘাত হানছে।

সাইবার প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকার ইতিমধ্যেই একটি ইন্টার-মিনিস্ট্রিয়াল প্যানেল গঠন করেছে। এই প্যানেল দেশের ব্যাংকিং, টেলিকম ও ইমিগ্রেশন সেক্টরে সাইবার প্রতারণার ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।

বিশেষ করে ফেক সিম কার্ড এবং অবৈধভাবে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণা সংঘটিত হচ্ছে। এইসব তথ্যের ভিত্তিতে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন দেশের একাধিক রাজ্যে পয়েন্ট অফ সেল এজেন্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যারা জাল পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে সিম জারি করেছিল।

সম্প্রতি দিল্লিতে ভারত ও কম্বোডিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে এক বৈঠকে ভারতীয় পক্ষ থেকে প্রতারণা কম্পাউন্ডগুলির সঠিক ভৌগোলিক অবস্থান জানিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। কম্বোডিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যে ভিত্তি করে তদন্ত শুরু করেছেন এবং এসব চক্র দমন করতে আগ্রহী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের সাইবার প্রতারণা বিশ্বব্যাপী একটি ‘নতুন রূপের মানব পাচার’ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে প্রযুক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষাকে বিপন্ন করা হচ্ছে।

ভারত সরকারের তরফে নাগরিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, কোনো অজানা ব্যক্তি বা সংস্থার প্রলোভনে পড়ে অনলাইন বিনিয়োগ বা অর্থ লেনদেন থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো সন্দেহজনক অ্যাপ, ফোনকল বা লিংক পেলে সঙ্গে সঙ্গে www.cybercrime.gov.in-এ অভিযোগ জানাতে হবে।