মিজোরামের রাজধানী আইজল যুক্ত হচ্ছে রেল নেটওয়ার্কে, একের পর এক রাজধানী সংযুক্ত হচ্ছে ভারতের রেল মানচিত্রে

নয়াদিল্লি , ৮ জুলাই : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল একটি দীর্ঘ অপেক্ষার পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে। ৬০ বছর আগে ১৯৬২ সালে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু গৌহাটির সারাঈঘাট ব্রিজ উদ্বোধন করেছিলেন, তখন গুয়াহাটির রেল সংযোগ শুরু হয়েছিল। এবার, মিজোরামের রাজধানী আয়জওলও ভারতের রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য শহরগুলির মতো, আয়জওলও যুক্ত হতে চলেছে ভারতের বৃহৎ রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে।

১৯৪৭ সালের পর, বিভাজন এর কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে ১৯৬২ সালে গৌহাটির সারাঈঘাট ব্রিজ উদ্বোধনের মাধ্যমে ভারতের রেল নেটওয়ার্ক পুনরায় সংযুক্ত হয় এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ৬০ বছর পর, ভারত রেল সংযোগের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজধানী শহরকে যুক্ত করতে চলেছে, যা পুরো অঞ্চলের জন্য এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

মিজোরামের রাজধানী আয়জওলকে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চলা বাইরাবি-সাইরাং রেললাইনটি একটি বিশাল প্রকল্প, যার মোট দৈর্ঘ্য ৫১.৩৮ কিলোমিটার এবং প্রকল্পটির খরচ ৫,০২১ কোটি টাকা। রেললাইনের নির্মাণ কাজটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল, কারণ এটি ভূমিধস প্রবণ লুশাই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এবং সিসমিক জোন-ভি (যেখানে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেশি) এলাকায় চলেছে। প্রকল্পটি ৪৮টি সুড়ঙ্গ, ৫৫টি প্রধান সেতু এবং ১০৪ মিটার উঁচু একটি পিয়ার নিয়ে তৈরি হয়েছে, যা দিল্লির কুতুব মিনারের চেয়ে ৪২ মিটার উঁচু। এই প্রকল্পটি ভারতীয় রেলওয়ে জন্য একটি প্রযুক্তিগত কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এখানে রেল সংযোগ স্থাপন করতে বাধা ছিল ভূতাত্ত্বিক সমস্যা, ভূমিধস এবং কর্মী সংকট।

মিজোরাম ও আসামের মধ্যে ভ্রমণের সময় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে এই রেললাইনটির মাধ্যমে, যা এই অঞ্চলের জনসাধারণ এবং বাণিজ্যের জন্য একটি বড় সুবিধা নিয়ে আসবে। রেল সংযোগ দ্রুত সেনাবাহিনীর মোতায়েনের কাজও সহজ করবে, কারণ এটি একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সাইরাং, আয়জওলের কাছাকাছি একটি শহরতলির শহর, রেললাইনের শেষ প্রান্ত হবে। এই রেল সংযোগটি এমন একটি সময়ে আসছে যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি, যেমন আগরতলা, ইতানগর এবং গৌহাটি, ইতিমধ্যে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

গুয়াহাটির সারাঈঘাট ব্রিজের মাধ্যমে ভারতের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া থেকে শুরু করে, ভারতের রেল সংযোগের প্রসার এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প। বর্তমানে, ২০২৫ সালে, ভারতের রেল নেটওয়ার্ক উত্তর-পূর্বের প্রতিটি রাজ্যের রাজধানী শহরগুলোতে পৌঁছাতে চলেছে। আয়জওলকে রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করার পর, ভারতের রেলওয়ে মন্ত্রক আগামী দশকের মধ্যে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতকে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার লক্ষ্য স্থির করেছে।

এটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, ঐতিহাসিকভাবে, দেশটির পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল এক সময় ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় রেলওয়ে প্রকল্পগুলির প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু অবশেষে দেশীয় রেল সংযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেলুনি, সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর — বহু স্থান এখন একে অপরের সাথে যুক্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে, মণিপুরের ইম্ফল, নাগাল্যান্ডের কোহিমা, মেঘালয়ের শিলং এবং সিকিমের গ্যাংটক, এই চারটি রাজধানীও রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর, ভারতে পার্টিশনের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং ভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে গৌহাটি পর্যন্ত রেল সংযোগ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শিলিগুড়ি করিডোর এবং জাতীয় মহাসড়কই হয়ে ওঠে একমাত্র স্থল সংযোগ। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ধীরগতি দেখা দেয়।

তবে সারাঈঘাট ব্রিজের মাধ্যমে ১৯৬২ সালে ভারতের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া গৌহাটি শহর উত্তর-পূর্ব ভারতকে পুনরায় ভারতীয় রেল নেটওয়ার্কের অংশ করে তোলে। এবং এখন, ৬০ বছর পর, এই অঞ্চলের সমস্ত রাজ্যকে রেল সংযোগের মাধ্যমে একসাথে আনা হচ্ছে।

আয়জওলের সঙ্গে রেল সংযোগের কাজ শেষ হলে, ভারতীয় রেলওয়ে মন্ত্রক মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, সিকিমের মতো রাজ্যগুলোকে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করবে। চলমান প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে, ইম্ফল (মণিপুর)-এর জন্য ১১০ কিলোমিটার জিরিবাম-টুপুল রেললাইন, কোহিমার জন্য ৮২ কিলোমিটার ডিমাপুর-জুবজা রেললাইন, শিলংয়ের জন্য ১০০ কিলোমিটার বাইরনিহাট-শিলং রেললাইন এবং সিকিমের গ্যাংটক পর্যন্ত সিভোক-রাংপো রেললাইন।

প্রকল্পগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং এগুলোর সাফল্য বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে রেল সংযোগও আরও সহজ করবে।

১৯৬২ সালে সারাঈঘাট ব্রিজের উদ্বোধন দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতীয় রেল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়েছিল, এবং ২০২৫ সালে আয়জওল এর পরবর্তী মাইলফলক। ২০৩০ সালের মধ্যে, যদি সব পরিকল্পনা সফল হয়, তবে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত রেল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ আরও মজবুত করবে এবং কৌশলগত গুরুত্ব বাড়াবে।