আগরতলা, ২০ ডিসেম্বর : আগরতলায় আগামীকাল উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্ষদের (এনইসি) ৭২তম পূর্ণাঙ্গ বৈঠককে সামনে রেখে আজ কেন্দ্রীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ডঃ সুকান্ত মজুমদারের পৌরোহিত্যে প্রাক-পূর্ণাঙ্গ বৈঠকের বিষয়গত ও কারিগরি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় বিভিন্ন মন্ত্রকের আধিকারিকরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উন্নয়নের রূপরেখার নতুন দিকসমূহ তুলে ধরেছেন, যা উত্তর পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহন করবে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী ডঃ সুকান্ত মজুমদার তাঁর ভাষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কেবল আমাদের দেশের ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, এটি দেশের বৈচিত্র্য, সংস্কৃতির একটি প্রতীকও বটে। ভারত, চীন, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভুটান এবং নেপালের সঙ্গমস্থলে থেকে এই অঞ্চলের অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান তাকে আঞ্চলিক সংযোগ, বাণিজ্য এবং কূটনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে পরিণত করেছে।
এই অঞ্চলের উন্নয়নে উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা স্বীকার করে ডঃ মজুমদার বলেন, এই অঞ্চলের অভুতপূর্ব উন্নয়ন, স্থায়ীত্ব এবং সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মন্ত্রকের অগ্রনী ভূমিকা গ্রহন করেছে। তিনি আরও বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির উন্নয়নের জন্য ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে এই মন্ত্রকের গঠন ছিল একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত।
বিগত কয়েক বছরে উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রক এবং ভারত সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু নীতি ও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, গত এক দশকে এই অঞ্চলে বিমানপথ, রেলপথ এবং জলপথের উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, “উত্তর-পূর্ব বিশেষ পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ, পর্যটন ও সামাজিক পরিকাঠামো বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্য সরকারগুলিকে ১০০% কেন্দ্রীয় তহবিল সরবরাহ করা হয়। ভারত সরকার এসএআরডিপি-এন ই, ভারতমালা-১ ইত্যাদির মতো কর্মসূচি গ্রহন করে পূর্ব-পশ্চিম করিডোর কর্মসূচির মাধ্যমে বাকি ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগের উন্নতির জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে এবং এই অঞ্চলে সরকারের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা সর্বোত্তম রূপ দেবার জন্য প্রত্যেক উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে প্রতি ১৫ দিনে একজন করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সফরের পরিকল্পনা করা হয়েছে । এই অঞ্চলের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সদর্থক ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “২০২৩-র জানুয়ারি থেকে ২০২৪-র মার্চ পর্যন্ত ৭৪ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ১৫৭ বারেরও বেশি উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফর করেছেন। তাদের এই সফর এই সব এলাকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি যেমন পর্যবেক্ষনের মধ্যে রয়েছে তেমনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সফল বাস্তবায়নে সহায়তা করছে।
মন্ত্রী বলেন, সীমান্ত বাণিজ্য পথের উন্নয়ন, স্মার্ট সিটি এবং ডিজিটাল পরিকাঠামো, কৃষি ভিত্তিক শিল্পের প্রচার, বাজারে প্রবেশাধিকারের উন্নতি এবং স্থিতিসীল ও স্থায়ী কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়নের মতো পুরো সম্ভাবনা উপলব্ধি করার জন্য এই অঞ্চলের জন্য এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যার সমাধান করা দরকার। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, রাজ্য সরকার এবং অন্যান্য অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে কাজ করতে পারি।
এদিনের আলোচনায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এদিন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা ও আলোচনা সত্যিই ফলপ্রসূ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “যেহেতু আমরা আগামীকাল পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাই আজ এখানে উপস্থিত সমস্ত অংশীদারদের আহ্বান জানাচ্ছি যে তাঁরা চ্যালেঞ্জের বাইরে গিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একসঙ্গে যেন কাজ করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এবং রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে পারি যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুস্থায়ী উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব চঞ্চল কুমার তাঁর ভাষণে বলেন, এই অঞ্চলের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন মন্ত্রকের উপস্থাপনা তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন রাজ্যের চিন্তা ভাবনার কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক উল্লেখ করেছে এবং এই অঞ্চলে সরকারি প্রকল্পগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সমস্ত অংশীদাররা একসঙ্গে কাজ করবে।
এনইসি-র সচিব অংশুমান দে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে প্রাক-পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, এনইসি-র পূর্ণাঙ্গ বৈঠকগুলি উত্তরপূর্বাঞ্চলের চাহিদা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ প্রদান করেছে, যা ভারত সরকার এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্য সরকারগুলির নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বিভিন্নভাবে রূপ দিয়েছে। গত এনইসি-র পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়। এগুলি হল-উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বিনিয়োগ নীতি-কর্মসূচি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য শিল্প ৪.০, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লজিস্টিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য-আমদানি বিকল্প-রপ্তানি। এই বিষয়ে গত এক বছরে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলির সফল পদক্ষেপে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতকে বিনিয়োগের প্রধান গন্তব্য হিসাবে গড়ে তোলার জন্য গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শ্রী দে বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন মন্ত্রক ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে উত্তর-পূর্ব বিনিয়োগকারীদের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে। তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে শিল্পের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একটি কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রের প্রকল্প হিসাবে নতুন শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প, ‘উন্নতি’ (উত্তর পূর্বা ট্রান্সফরমেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন স্কিম) ২০২৪ প্রণয়ন করেছে।
কারিগরি অধিবেশনে, এই অঞ্চলের উন্নয়নে আরও উৎসাহদানের জন্য ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের উপর আলোচনা করা হয়। যেমন, জাতীয় পাম তেল মিশন এবং পাম তেলের এলাকা সম্প্রসারণ করতে উত্তর-পূর্বকে কাজে লাগানো, ফোর-জি স্যাচুরেশন প্রকল্প ইত্যাদি।
এই অঞ্চলে পাম তেল উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে শ্রী দে বলেন, ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা অর্জনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি রাজ্য-অরুণাচল প্রদেশ, অসম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরায় পাম তেল উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে, যা ৮.৪ লক্ষ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে। এই পাম তেল উৎপাদন জাতীয় সম্ভাবনার ৩৮% পর্যন্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে ৩০ লক্ষেরও বেশি নার্সারি স্থাপন করা হয়েছে। আজকের অধিবেশনে এনইসি-র সদস্য, রাজ্যসুমুহের মুখ্যসচিবগণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ উপস্থিত ছিলেন।