BRAKING NEWS

অনাচার পছন্দ করে না খান্দরা বকসি  বাড়ির ক্ষ্যাপা মা দুর্গা

দুর্গাপুর, ৪ অক্টোবর (হি.স.) : অপরিস্কার আর মিথ্যাচার একেবারই পছন্দ করেন না। অনাচার হলেই মা দুর্গা বিড়ম্বনা দেখায়। তাই অন্ডালের খান্দরা বকসি বাড়ির   দুর্গা মাকে ক্ষ্যাপা মা বলা হয়। আর বকসি বাড়ির   দুর্গা পুজোয় জড়িয়ে রয়েছে নানান ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ২৭৬ বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে দুর্গার   প্রতিষ্ঠা করেন গোবর্ধন বকসি। তিনি বৈষ্ণব ধর্মাবল্মী ছিলেন। তার   বীরত্বের জন্য বর্ধমানের মহারাজাদের কাছে বকসি উপাধি পেয়েছিলেন।  তাঁর   বাবা কিশোরী মোহন দাস। তিনি ছিলেন তৎকালিন সময়ে খ্যাতনামা তন্ত্রসাধক। আসল বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের জজান পাস্থায়ী গ্রামে। সেখান থেকে সস্ত্রীক খান্দরায় বসবাস শুরু করেন। পরে তার এক পুত্র সন্তান হয়। কিন্তু ওই সন্তানকে আবারও জজান পাস্থায়ী গ্রামে রেখে বৃন্দাবন চলে যান। বছর   পনের   পর আবারও খান্দরায় ফিরে আসেন। কথিত আছে বর্ধমানের মহারাজা শিকার   করতে এসেছিলেন খান্দরার জঙ্গলে। ওই সময় ছোট্ট একটি খুপরি   ভাঁড়ে মহারাজের সৈন্যদের রান্না করে   খাইয়েছিলেন। কিশোরী মোহনের অতিথী আপ্যায়নে খুশি হয়ে তাকে কিছু দেওয়ার   প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবং খোঁজ নিয়েছিলেন তার পুত্র গোবর্ধন কোথায়। তা জানতে পেরে মহারাজ মুর্শিদাবাদে ঘোড়ার রথ ও হাতি পাঠিয়ে ছিলেন। তখনই মহারাজ কিশোরী মোহনের ছেলে গোবর্ধনকে তাঁর সেনাপতি করেছিলেন। সেনাপতি কাজের   জন্য একটি তরবারি দিয়েছিলেন।  আজও ওই তরবারি   বিজয়া দশমীর   দিন বকসি বাড়ির সকলে মাথায় স্পর্শ করে।  পরে গোবর্ধন দাসের   বীরত্বের জন্য বকসি উপাধি দিয়েছিলেন তৎকালিন মহারাজা। আর সেই থেকে  গোবর্ধন দাস থেকে বকসি হলেন। তিনি ছিলেন শক্তির উপাসক। দেবী দুর্গা স্বপ্নদেশ দেয় তার   পূজা করার জন্য। কে মূর্তি গড়ে দেবে, কী ভাবে মায়ের পূজা করবেন তা জানতেন না। কথিত আছে মা দুর্গা ওই একই দিন কাটোয়ার   দাঁইহাটের একছুতোরকে মূর্তি গড়ার স্বপ্ন দিয়েছিলেন।  ঠিক যেমন স্বপ্নাদেশে গোবর্ধন বকসির সঙ্গে সাক্ষাতের   কথা জানিয়েছিলেন সেরকম একটি গাছের   নীচে সাক্ষাৎ হয়েছিল। শুধু তাই নয় ঠিক যেরকম প্রতিমা গড়ার স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন ঠিক সেরকম আজও মূর্তি গড়া হয়। শিউলি ফুলের বোঁটার মত গাঁয়ের রং, আটটি হাত ছোট,  সামনের   দুটি হাত বড়।  তাছাড়াও সাধারনত মায়ের   বাঁ দিকে কার্তিক ও ডান দিকে গনেশ থাকে।  কিন্তু বকসি বাড়ির মা দুর্গার ডানদিকে থাকে কার্তিক এবং বাঁ দিকে থাকে গনেশ।মা দুর্গার   বেদী প্রতিষ্ঠার   জন্য পঞ্চ মুন্ডীর   আসান প্রতিষ্ঠা করেন কিশোরী মোহন দাস।আর তাই গোটা মন্দির সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হলেও ভেতরের মেঝে মাটির।  পরবর্তীকালে কিশোরী মোহনের   মৃত্যুর   পর   তার বসত বাড়ির   পিছনে সমাধি দেওয়া হয়। ওই সমাধিতে বকসি বাড়ির সকলে প্রতি পঞ্চমী ও দশহারার   দিন পুজো দিয়ে থাকে। এছাড়াও সমাধিতে লাগানো মনসা গাছ দুর্গাষষ্ঠির   দিন বিসর্জন দিয়ে নতুন লাগানো হয়। বকসি পরিবারের   প্রবীন সদস্য সুখেন্দু বকসি জানান, “পুজোয়  বলি নির্দিষ্ট। অর্থাৎ সপ্তমীতে একটি ছাগ অষ্টমীতে এক রঙের একটি ছাগ নবমিতে তিনটি বলি একটি ছাগ, একটি মোষ, একটি চালকুমড়ো,  এক গোছা আঁখ। বকসি পরিবারের   কেউ বলি দেখবে না। এমনিকি বলির রক্ত পর্যন্ত পরিবারের   কেউ দেখবে না।” তিনি আরও জানান, “মা মিথ্যাচার   ও অপরিস্কার   পছন্দ করেন না। একবার   এক মহিলা অসুস্থ অবস্থায় মায়ের   পাটে হাত দিয়েছিল। সেবারে মোষ বলিতে খুঁত অর্থাৎ একচোটে বলি হয়নি। কয়েকদিন পরে ওই মহিলা কুষ্ঠ হয়ে মারা   যায়। এছাড়াও একবার   এক মহিলা মায়ের   দিব্যি খেয়ে মিথ্যা বলেছিল। আর   তার পরিনাম কয়েকজনের মাঝে থাকা ওই মহিলাকে এক বিষধর সাপ দংশন করে   মন্দিরে ঢুকে যায়।” সুখেন্দু বাবু জানান, “১৯৫৭ সালে সিরাজদ্দৌলার   পতনের পর ব্রিটিশদের সঙ্গে দেশীয় রাজাদের   দ্বন্দ শুরু হয়। তখন জামুড়িয়ার   কাছে বিজয়নগরে ব্রিটিশদের সঙ্গে বর্ধমানের রাজাদের   যুদ্ধ শুরু   হয়। গোবর্ধন সেনাপতি যুদ্ধে যাচ্ছেন। মাঝপথে নীলকন্ঠ তলায় ১১-১২ বছরের একটি মেয়ে তার পথ আটকে যুদ্ধে যেতে মানা করে।  জানায় ওইদিন যুদ্ধে তার ক্ষতি আছে। কিন্তু মেয়েটির   বাধা না মেনে চলে যান। এদিকে ওই মেয়েটি আবার   বাড়িতে খবর দেয় সেনাপতি গোবর্ধন যুদ্ধে আহত হয়েছ। পরে   গোবর্ধন বকসি বুঝতে পারে   মেয়েটি আর   কেউ নয় স্বয়ং মা দুর্গা তাকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেছিল।” তিনি আরও জানান,” বংশপরম্পরায় দাঁইহাটের   ওই ছুতোরে বংশধররা মুর্তি গড়ে।  এক সময় বকসিদের চরম আর্থিক অনটন ছিল।  সেবারে টাকা না পাওয়ায় অক্ষয় সূত্রধর নামে এক কারিগর মায়ের চক্ষুদান করতে অস্বীকার করে। কয়েকদিন পর ওই কারিগরের দুটো চোখ নস্ট হয়ে যায়।” সুখেন্দুবাবু জানান, “ক্ষ্যাপা মা সকলের মনের বাসনা পূর্ন করে। সাধারন মানুষ তাই ঢাক মানত করে। মন বাসনা পূর্ন হলে পুজোর সময় ঢাক দেয়। আর তাই ঢাকের বাজনা দেখতে মানুষের ঢল নামে। প্রায় একশোর   বেশি ঢাক হয়। তাদের শোভা যাত্রার মাধ্যমে সপ্তমীর   দিন নবপত্রিকা স্নান করানো হয় গ্রামের ধোবে পুকুরে। বকসিদের যে ঘাটে স্নান হয় ওই ঘাটে অন্য কোন ঠাকুরের নবপত্রিকার স্নান হয় না।” তিনি আরও জানান,” সম্পূর্ন বৈষ্ণবমতে পূজা হয়। সপ্তমী অষ্টমী নবমীর   দিন বলি হলেও বকসি পরিবারের সকলে নিরামিষ খেয়ে থাকেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *