BRAKING NEWS

সগৌরবে একাত্তর বছরে জাগরণ

।। সন্দীপ বিশ্বাস ।। 

হাজারো ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করিয়া জাগরণ আজ একাত্তর বছরে পা দিয়াছে। ১৯৫৪ সালের দোসরা অক্টোবর জন্মলগ্ন থেকেই দৈনিক প্রকাশনায় আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল জাগরণ। আজ বহু স্মৃতি শুধুই উঁকি মারিতেছে। দীর্ঘ একাত্তর বছরে জাগরণ হারাইয়াছে তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক স্বাধীনতা সংগ্রামী জিতেন্দ্র চন্দ্র পালকে। তাঁর অনুজ প্রতীম জাগরণ-এর সর্বশেষ কর্ণধার পরিতোষ বিশ্বাস দুরারোগ্য ব্যাধির সাথে কঠিন লড়াই সংগ্রামের পর গত তেইশে ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হইয়াছেন। তাঁহার প্রয়াণে ত্রিপুরার সংবাদ জগতে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হইয়াছে, তাহা অস্বীকার করিবার সুযোগ নাই। তাই, আজ জাগরণ-এর বর্ষপূর্তি-তে তাঁহার শূন্যতা আমাদের ব্যথিত করিতেছে। কারণ, পরিতোষ বিশ্বাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাগরণকে নিজের বুকে আগলাইয়া রাখিয়াছেন। সজ্ঞানে তাঁহার শেষ কথা ছিল, জাগরণ আমার প্রাণ। 

অতীতের পাতায় ফিরিয়া দেখিলে অনেকেরই হয়তো মনে পড়িবে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ত্রিপুরায় দৈনিক পত্রিকা ছিল শুধুই জাগরণ। স্বর্গীয় জিতেন্দ্র চন্দ্র পালের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খুবই ছোট পরিসরে জাগরণ প্রকাশিত হইত। অর্থবল তেমন ছিল না, তাই তাঁহাকে প্রতিনিয়ত পত্রিকা প্রকাশনায় সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। সময়ের সাথে দেশের এবং রাজ্যের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। কিন্ত দুর্ভাগ্যের হইলেও সত্য জাগরণ-র কলেবর তেমন বৃদ্ধি হয় নাই। অবশেষে ১৯৮১ সালে জাগরণ প্রকাশনার গুরু দায়িত্ব স্বর্গীয় জিতেন্দ্র চন্দ্র পাল তুলিয়া দিয়াছিলেন পরিতোষ বিশ্বাসের কাঁধে। 

জাগরণ প্রকাশনার শুরু থেকেই নানাহ সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন পরিতোষ বিশ্বাস। আর্থিক সংকট এই পত্রিকা প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু, হাজারো প্রতিকূলতার মাঝেও জাগরণকে বুকে আগলাইয়া রাখিয়াছেন তিনি। পত্রিকার প্রতিষ্ঠান বিরোধী নীতির কারণে প্রতিপদে তাঁহাকে হোঁচট খাইতে হইয়াছে। এমনকি, তাঁহাকে প্রাণে মারিবার চেষ্টা হইয়াছে। মঠ চৌমুহনীতে তাঁহার অফিস আক্রান্ত হইয়াছে। ওই সময় রাজ্যের সমস্ত সাংবাদিকরা তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া প্রতিবাদে সোচ্চার হইয়াছিলেন। ফলত, তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার তাঁহাকে দেহরক্ষী প্রদানে বাধ্য হইয়াছিল। 

অতীতের পাতায় চোখ রাখিলে স্পষ্ট নজরে আসিবে, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা জাগরণকে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছিল। পরিণামস্বরূপ পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করিবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হইয়াছিল। ওই সময় জাগরণ প্রকাশনা বন্ধ হইয়া যাইবার খবরে বিধানসভার ভেতরে এবং বাইরে তোলপাড় হইয়াছিল। ফলে, তদানীন্তন   বামফ্রন্ট সরকার জাগরণকে বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হইয়াছিল। তবুও, বঞ্চনা থামিয়া যায় নাই। 

যুগের সাথে তাল মিলাইয়া জাগরণ কলেবরে বৃদ্ধি ঘটিয়াছে। মুদ্রণ মাধ্যমের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমেও জাগরণ পা দিয়াছে। স্বর্গীয় জাগরণ সম্পাদক সময়ের চাহিদা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই, ২০০৮ সালে জাগরণ তাঁহার হাত দিয়া ডিজিটাল মাধ্যমে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কঠিন পরিশ্রম এবং প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা অজান্তেই শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করিতেছিল, তাহা তিনি হয়তো বুঝিতে পারেন নাই। দীর্ঘ সময় ধরিয়া তিনি উচ্চ রক্তচাপ এবং মধুমেহ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ওই সময় তাঁহার বাচিয়া ফিরিবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ ছিল। ঈশ্বরের অসীম কৃপায় সে যাত্রায় তিনি সুস্থ হইয়া বাড়ি ফিরিয়াছিলেন। 

তাহার পর তিনি পুণরায় সংগ্রাম করিয়া চালাইয়া যাইতেছিলেন। তের বছর বাদে তাঁহার হৃদযন্ত্রে পুণরায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁহাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বহি:রাজ্যে নেওয়া হইয়াছিল। সেখানে তাঁহার বাইপাস সার্জারি হইয়াছিল। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সনামধন্য  চিকিৎসক ডা: দেবী শেট্টির তত্বাবধানে তাঁহার অস্ত্রোপচার হইয়াছিল। তখন থেকেই তাঁহার শারীরিক সমস্যা শুধুই বাড়িতেছিল। হৃদযন্ত্রে সফল অস্ত্রোপচার হইলেও ক্রমশ তাঁহার কিডনি খারাপ হইতেছিল। ফলে, ২০১৯ সাল থেকে তাঁহাকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য ডায়ালাইসিস-এর উপর নির্ভরশীল হইতে হইয়াছে। ২০২০ সালে সারা বিশ্ব  জুড়িয়া মারণব্যাধি করোনা-র থাবা পরিয়াছিল। জাগরণ-এর স্বর্গীয় সম্পাদক ওই সময় করোনা আক্রান্ত হইয়াছিলেন। প্রতিনিয়ত আঘাত সহ্য করিয়া তিনি বাঁচিবার রসদ খুজিয়া পাইতেন জাগরণ-এর নিয়মিত প্রকাশনার  মধ্য দিয়া।

অসুস্থতা সত্বেও জাগরণ সম্পর্কে তাঁহার সজাগ দৃষ্টি ছিল। জাগরণ-এর দায়িত্ব কাঁধে তুলিয়া নেওয়ার পর থেকে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন তিনি নিজেই লেখিতেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন খবরের শিরোনাম লেখার ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ঠ অবদান রাখিতেন। সময়ের সাথে তাঁহার শারীরিক অসুস্থতা বাড়িয়াছে। ফলে, এক সময় নিরুপায় হইয়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লেখা বন্ধ করিয়াছেন। তবে, পত্রিকার যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি নজরদারি বন্ধ করেন নাই। কিন্তু, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে তিনি মারাত্মকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টায় তাঁহাকে বাঁচাইতে সক্ষম হইলেও মস্তিষ্কে প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয় নাই। তাহার পর থেকেই তাঁহার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হইতে শুরু হইয়া যায়। ২০২৪ সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন। 

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে জাগরণ পড়া তিনি বাদ দেন নাই। সজ্ঞানে তিনি বলিয়া গিয়াছেন, জাগরণ তাঁর প্রাণ। আজ তাঁহাকে ঘিরিয়া পুরনো সব স্মৃতি মনে পড়িতেছে। সময়ের সাথে সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকতায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়াছে। কখনো যাহা ছিল শুধুই নেশা, আজ তাহা পেশায় পরিণত হইয়াছে। স্বর্গীয় পরিতোষ বিশ্বাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ একাত্তর বছরে জাগরণ মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পথ যতই কঠিন হোক, জাগরণ সর্বদাই লক্ষ্যে অবিচল থাকিবে। একথা অস্বীকার করিবার সুযোগ নাই,  তাঁর অভাব প্রতিনিয়ত অনুভূত হইবে। কিন্তু, তাঁহার দেখানো পথেই জাগরণ-এর পথচলা অব্যাহত থাকিবে। সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে তাঁহার সুখ্যাতি জাগরণ-এর আগামির পথ চলার দিশা দেখাইবে। সেই প্রত্যাশাই রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *