BRAKING NEWS

রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রম হাসি ফুটছে অসংখ্য পিংকিদের মুখে

৷৷ পারিজাত দত্ত৷৷

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একদিন অকস্মাৎ আগুনে ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেল মাতাবাড়ির বাসিন্দা পিংকির৷ হাতে নেই একটি টাকাও৷ বিপদের দিনে সংসার ছেড়ে চলে গেছেন স্বামীও৷ ছেলের হৃদযন্ত্রে ফুটো৷ অস্ত্রোপচারে রাজি নয় পরিবারের লোকজন৷ ঝুঁকি নিয়ে অপারেশন করাতে বণ্ডে সই করলেন পিংকি৷ সেই মুহূর্তে পিংকি ভয় পাচ্ছিল অস্ত্রোপচার যদি সফল না হয় তখন কী করবে সে? সেই মুহূর্তে তার যা মনের অবস্থা, সেই দোলাচল যেন আজও প্রতিধবনিত হচ্ছিল তার গলায়৷
পিংকি বলছিলেন, তার ছেলে দেবব্রতর কথা৷ দেবব্রতর ডাক নাম কৃষ্ণ, বয়স ১৩ বছর৷ মাতাবাড়ি অমরনগর সুকলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র৷ জন্মের পর তার যখন ২১ দিন বয়স তখনই ধরা পড়েছিল তার হৃদযন্ত্রে গোলযোগ রয়েছে৷ পরবর্তী সময়ও হাসপাতালে দেখানো হয়েছিল দেবব্রতকে৷ অস্ত্রোপচার করতে হবে জেনে শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী বাধা দেয়৷ তার যখন বয়স আট কিংবা নয়, তখন একবার এসেছিল আরবিএসকে টিম৷ বলেছিল বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের কথা৷ কিন্তু তখনও তার বাবা রাজি না হওয়ায় শেষ পর‌্যন্ত অপারেশন করা আর হয়ে উঠেনি৷ সুকল থেকে ফিরে অনেক সময় বুকে অসম্ভব ব্যথা করছে, বলত সে৷ কিন্তু তার বাবা রাজি না থাকায় ছেলের জন্য পিংকি কিছুই করতে পারছিলেন না৷
মাতাবাড়িতে ভাড়া বাড়িতে ছেলে ও ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী থাকতেন৷ পিংকির স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন৷ কখনও কখনও আবার ট্রাক্টরও চালান৷আর পিংকি গৃহ পরিচারিকা৷ গত পৌষ মাসেএক শীতেরদুপুরে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়ের জন্য গরম পোশাক কিনবে বলে বাড়ি থেকে বের হন পিংকি৷ কী মনে করে যেন ছেলে ও মেয়ে দু’’জনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷ কিছুক্ষণ পর খবর পেলেন বাড়িতে আগুন লেগেছে৷ এক ছুটে বাড়ি ফিরে দেখলেন বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে৷ পাশের ভাড়াটিয়া ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে৷ কোনও কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারেননি পিংকি৷ সর্বগ্রাসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেতার যাবতীয় সম্বল৷
পিংকির কথায়, এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম৷ সেই কাপড়খানিই ছিল আমাদের সম্বল৷ আর কিছুই নয়৷ পিংকি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার স্বামী থাকতেন ভাড়া বাড়িতে৷ এবার স্বামী চলে গেল তার নিজস্ব বাড়িতে, বাবা মায়ের কাছে৷ সেখানে আর যাওয়া হয়নি পিংকি ও তার ছেলেমেয়েদের৷ তাদের নিয়ে শুরু হলো পিঙ্কির বেঁচে থাকার লড়াই৷ ছেলের শরীরের অবস্থা তখন খারাপ৷
পিংকি ঠিক করলো যেভাবেই হোক ছেলেকে সুস্থ করে তুলবে৷ সে নিজেই যোগাযোগ করলো গোমতী জেলার আরবিএসকে টিমের সঙ্গে৷ এলাকারই একটি শিশু আরবিএসকে টিমের সহযোগিতায় ব্যাঙ্গালোরে অপারেশন করে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে৷ তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পিংকি ছুটলেন রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার‌্যক্রমের চিকিৎসক দলের সঙ্গে কথা বলতে৷ ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই ত্রিপুরা সুন্দরী হাসপাতালের আরবিএসকে টিম স্ক্রিনিং করল তার৷ ধরা পড়লো হৃদযন্ত্রে দুটো ফুটো রয়েছে দেবব্রতের৷ পরীক্ষা করে তড়িঘড়ি তার অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করলেন ডাঃ নন্দন দেবনাথের নেতৃত্বে মেডিকেল টিম৷ ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই অস্ত্রোপচারের তারিখ ঠিক হলো৷
সে সময় পাহাড় যেন ভেঙে পড়ল পিংকির মাথায়৷ হাতে টাকা নেই তার৷ যদিও আরবিএসকের কল্যাণে অস্ত্রোপচারের জন্য কোনও টাকা খরচ হবে না৷ কিন্তু তাদের যাতায়াত, আগরতলায় থাকা-খাওয়া, সমস্ত কিছু মিলিয়ে কিছু টাকা তো দরকার৷ এই টাকা জোগাড় করবার জন্য টেনশন৷ তার উপর অস্ত্রোপচার যদি ব্যর্থ হয়, তখন কি হবে, সেটা ভেবেও মাথা নষ্ট হয়ে যাবার যোগাড় তার৷ ছেলের কথা যেমন ভাবতে লাগলেন, তেমনি নিজের কথাও ভাবতে লাগলেন তিনি৷ তার কথায় আমার ছেলের যদি অস্ত্রোপচার ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাকে মাতাবাড়ি এলাকা ছাড়া তো করবেই, আমাকে বাঁচতেও দেবে না আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন৷ হাসপাতালে অপারেশনের আগে যখন বণ্ডে সই করছিলাম, তখন আমার সে কি যন্ত্রণা, কি কষ্ট, সেটা বলে বুঝাতে পারব না৷
ডাক্তার বাবুরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বুঝিয়ে ছিলেন যে কোনও ভয় নেই৷ ছেলে আমার ভালো হয়ে যাবে৷ আইএলএস হাসপাতালে অপারেশন হলো৷ এখন ছেলে ভালো হয়ে গেছে অনেকটাই৷ কথা বলতে বলতে গলা আবেগে বুঁজে এলো তার৷ বললেন, রক্ত দিয়েও ঋণ শোধ করতে পারবো না এই ডাক্তারবাবুদের৷ তাদের জন্যই আমার ছেলে ভালো হয়ে ফিরে এসেছে৷ ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অপারেশনের পর আগস্ট মাসে, তারপর অক্টোবর মাসে এবং নভেম্বর মাসে আরবিএসকে টিম এসে ছেলের শরীরের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছে৷ সম্প্রতি আবারও এসেছিল আরবিএসকে টিম৷ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছে কৃষ্ণকে৷ দিয়ে গেছে পরামর্শও৷ আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ৷ ফার্মাসিস্ট রাজেশ ভৌমিককে নিয়ে ডাঃ নন্দন দেবনাথ বারবার গিয়েছেন সেখানে পরীক্ষা করেছেন তাকে৷ ২১ আগস্ট, ২০২৪ এও ডাঃ নন্দন দেবনাথ ফোন করে খবর নিয়েছেন দেবব্রতর৷ সে এখন সুস্থ৷ রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার‌্যক্রমের মেডিকেল টিম এই ভাবেই হাসি ফুটিয়ে চলেছে অসংখ্য পিংকিদের মুখে৷
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর থেকে এই ফিচারটি দেওয়া হয়েছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *