কলকাতা, ৯ ডিসেম্বর : ভারত সরকার ঘোষিত ২০৭০ সালের মধ্যে জিরো কার্বন নিঃসরণ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নকে জোরদার করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা নিচ্ছে ত্রিপুরা সরকার। ৯ ডিসেম্বর শনিবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত ২৫তম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শক্তি কমিটির (NERPC) বৈঠকে অংশগ্রহণ করে এই দাবি করেন ত্রিপুরার বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতনলাল নাথ।
এনটিপিসির তত্ত্বাবধানে এই সভাটি আয়োজিত হয়েছে। সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনায়ই ছিল ওই সভার মূল উদ্দেশ্য। ওই বৈঠকে ত্রিপুরার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সূর্যমনিনগরে ৪০০ কেভি সাব স্টেশনের কাজ দ্রুত রূপায়ণ করা হবে। তাতে পালাটানা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরাসরি ৪০০ কেভি পরিবাহী লাইনের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে বিদ্যুৎ পরিবাহী ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা ও স্থিতিশীলতার উন্নতি হবে।
এছাড়া, ১৩২ কেভি ডাবল সার্কিট মনারচক থেকে সূর্যমনিনগর পর্যন্ত লাইনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। তাতে মনারচক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি ডাবল সার্কিট লাইনের মাধ্যমে সূর্যমনিনগর সাব-স্টেশনে আসবে। পাশাপাশি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ পরিবাহী লাইনে সার্জ এরেস্টার স্থাপন করতে হবে, তাতে ঝড় বৃষ্টির সময়ে বজ্রপাতের কারণে পরিবাহী লাইনের কোন ক্ষতি না হয় এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ত্রিপুরার বিদ্যুৎ পরিবাহী ব্যবস্থাপনায় উচ্চ ক্ষমতা যুক্ত মোবাইল সাব-স্টেশনের অন্তর্ভুক্তিকরণ হবে, যা বর্তমান কোনো সাব-স্টেশনে সমস্যা দেখা দিলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে জরুরী ভিত্তিক পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। বিদ্যুৎ পরিবাহী ব্যবস্থাপনায় মোবাইল টাওয়ারের (Emergency Restoration System) সংযুক্তিকরন হবে, যা কোন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাহী টাওয়ারের জরুরী ভিত্তিক প্রতিস্থাপনে সাহায্য করবে।
এছাড়া বৈঠকে উচ্চ ক্ষমতার পরিবাহী চালু লাইনের মেনটেনেন্স করার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রাদির ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাতে বিদ্যুৎ পরিবহন চালু রেখেই পরিবাহী লাইনে কাজ করা যাবে। ফলে গ্রাহক পরিষেবা বিঘ্নিত হবে না। ড্রোন দ্বারা উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত পরিবাহী লাইনের পর্যবেক্ষণেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে, কুমারঘাট স্থিত পূর্ব কাঞ্চনবাড়িতে আরও একটি স্টেট লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার (এসএল ডিসি) স্থাপন করা হবে যা আগরতলাস্থিত এসএলডিসির ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতায় ২৫ তম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক পাওয়ার কমিটির বৈঠকে রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী ত্রিপুরার সার্বিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অগ্রগতির জন্য বক্তব্য রাখেন। এর আগে ৮ ই ডিসেম্বর একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৫ তম টেকনিক্যাল কোঅর্ডিনেশন কমিটির বৈঠক। উভয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমের ব্যবস্থাপনা অধিকর্তা দেবাশীষ সরকার এবং ত্রিপুরা পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন দেববর্মন।
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক পাওয়ার কমিটির বৈঠকে বিদ্যুৎ মন্ত্রী রতনলাল নাথ জানান, রাজ্য ভারত সরকার ঘোষিত ২০৭০ সালের মধ্যে জিরো কার্বন নিঃসরণ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নকে জোরদার করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত কুড়ি মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন সহ ৪০ হাজার সোলার স্ট্রীট লাইট, ২৫০০ সোলার পাম্প, ৩ মেগাওয়াট সোলার রুফটপ স্থাপন করা হয়েছে। ত্রিপুরার গোমতী জেলায় অবস্থিত ডম্বুর জলাশয়ে ১৩০ মেগাওয়াট ভাসমান সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে রাজ্য সরকার। এর জন্য ভারত সরকারের অধীনস্থ সংস্থা এনটিপিসিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজ্যে পিক লোড আওয়ারে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করার জন্য সূর্যালোক থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সঞ্চয় করার জন্য ত্রিপুরায় স্টোরেজ ব্যাটারি স্থাপনেরও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সাথে পাম্পস্টোরেজ প্রকল্প (PSP) উন্নয়নের জন্য গত ১০ এপ্রিলে প্রকাশিত ভারত সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুসারে রাজ্যে পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প তৈরি করা হবে। প্রাথমিকভাবে রাজ্যে পাঁচটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকল্প গুলোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য ভারত সরকারের অধীনস্থ সংস্থা এনএচপিসি-কে বলা হয়েছে এবং ওই সংস্থা কাজও শুরু করেছে।
তিনি বলেন, ভারত সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় উত্তরপূর্ব আঞ্চলিক বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প (NERPSIP) এর কাজ চলছে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে। এই প্রকল্পের অধীনে নতুন ট্রান্সমিশন লাইন ও সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ দ্রুততার সাথে সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনকে বলা হয়েছে।
ত্রিপুরা সরকার রাজ্যে বিদ্যুৎ বিতরণ দক্ষতা জোরদার ও উন্নত করার জন্য এডিবির সাথে ২২৭৫ কোটি টাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই প্রকল্পের অধীনে সিপাহীজলা জেলার রোখিয়া ও গোমতী জেলার বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আধুনিকরণের মাধ্যমে প্রকল্পের স্থাপিত ক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে, বলেন তিনি।
সাথে তিনি যোগ করেন, এডিবির অর্থায়িত প্রকল্পের অধীনে বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষেত্রে আধুনিকরণ এবং নির্ভরযোগ্যতার উন্নতির মধ্যে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন কভার কন্ডাক্টর, হাইভোল্টেজ ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, ফল্ট প্যাসেজ ইন্ডিকেটর, রিং ম্যান ইউনিট (RMU), ট্রান্সফরমার টেস্টিং ল্যাব, স্মার্ট মিটারিং ইত্যাদি। তিনি বলেন, আগরতলা শহরে ১১ কেভি ভূগর্ভস্থ বিদ্যুতের তার স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এবং সে মোতাবেক কাজও চলছে। পরবর্তী সময়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে ওভারহেড ডিস্ট্রিবিউশন লাইনগুলো (এলটি) ভূগর্ভস্থ তার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।
তাঁর দাবি, ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাইবার নিরাপত্তা। সাইবার নিরাপত্তা হলো ডিজিটাল বা সাইবার আক্রমণ থেকে সিস্টেম, নেটওয়ার্ক এবং প্রোগ্রামগুলোকে রক্ষা করা। ভারত সরকার অধীনস্থ সংস্থা সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি অথরিটি (CEA) বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। সে মোতাবেক রাজ্যে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য স্টেট লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।