দুর্গাপুর, ১৭ নভেম্বর (হি. স.) একশ’দিনের প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, আয়লা ক্ষতিপুরণের পর এবার ইসিএলের উচ্ছেদ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে অনিয়ম। গোটা রাজ্য যখন দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড়। তখন ইসিএলের পুনর্বাসন নিয়ে বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠল খনিঅঞ্চল পান্ডবেশ্বরে ভাটমুড়া গ্রামে। আর তার প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিজেপি।
প্রসঙ্গত, কয়লাকান্ডে তোলপাড় গোটা রাজ্য। কেন্দ্রীয় গয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ও রাজ্যের সিআইডি অবৈধ কয়লার চোরাচালনে ধরপাকড় শুরু করেছে। ঘটনায় একাধিক কয়লা মাফিয়া ধরা পড়েছে। ঘটনার তদন্তে জোর তৎপরতা শুরু করেছে রাজ্য কেন্দ্র উভয় গয়েন্দা বিভাগ। এমনকি খনি সংস্থা ইসিএলের বেশ কয়েকজন আধিকারিকও গ্রেফতার হয়েছে। কয়লা পাচার কাণ্ডে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থার। এবার ইসিএলের খনি সম্প্রসারণে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পাইয়ে কোটি টাকা আত্মসাত দুর্নীতির অভিযোগ উঠল পান্ডবেশ্বরের শোনপুর বাজারি প্রজেক্টে।
প্রসঙ্গত, শোনপুবাজারি প্রজেক্টের কয়লা এনটিপিসি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে জোগান হয়। এখানে উন্নতমানে জি-৪ গ্রেডের কয়লা উৎপাদন হয়। যার গুনগতমান খুবই ভাল। গুনগত মান ভাল, তাই চাহিদা প্রচুর। লাভজনক প্রজেক্ট। তাই সম্প্রসারণ জরুরী। কয়লা মজুত যা রয়েছে, তাতে এখনও ৩২ বছর পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন করা যাবে। গত অর্থবছরে ৭১.৭২ কিউবিক মিটারে ১২ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদন হয়েছে। গত অর্থ বছরে ওই প্রজেক্টে ২৪৫০ কোটি টাকা মুনাফা দিয়েছে। এবার লক্ষ্য ৩০৫২.৩২ কোটি টাকা। নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাতে একগুচ্ছ নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে কয়লা উত্তোলক সংস্থা ইসিএল। কয়লা পরিবহণে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি। তাই প্রজেক্টের উৎপাদন ভাল হওয়ায় লাভজনক। সম্প্রতি প্রজেক্টের বছরে ১২ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদনের ছাড়পত্র পায়। শোনপুর বাজারি সম্প্রসারণে মোট জমির প্রয়োজন ৪৬৮১ হেক্টর জমি। তার মধ্যে ২৮৩৪.৩১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বাকি রয়েছে ১৮৪৭ হেক্টর।
ইসিএল সূত্রে জানা গেছে, শোনপুর আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভাটমুড়া, মধুডাঙা, শোনপুর বাজারী গ্রাম সহ ১০ টি গ্রাম অধিগ্রহণে কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই প্রজেক্টের সম্প্রসারনের দরুন বেলডাঙা, হাঁসডিহা, আরশোলা, রুইদাস পাড়া, পাথরডাঙা, কুচিবেড়া, ভালুকা, শোনপুরসুগ্রাম সহ ১৬৭০ টি পরিবার পুনরবাসিত হয়েছে ও ক্ষতিপুরন পেয়েছে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় রয়েছে ভাটমোড়া , মধুডাঙা, শোনপুর বাজারি। ইতিমধ্যে ভটমুড়া ও মধুডাঙার সার্ভে কাজ শেষ। জানা গেছে পুনর্বাসনের গোল্ডেন প্যাকেজে গ্রামবাসীদের জমি ও বাড়ির মূল্য নির্ধারিত করা হয়। তাতে বাড়ীর জন্য সর্বনিম্ন ৩ লক্ষ ২৫ হাজার ক্ষতিপুরণ দেওয়া হয়। গোওয়াল ঘরের জন্য ২৫ হাজার টাকা ও জিনিসপত্র স্থানান্তরিত করার খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এছাড়াও রোজগারের ক্ষতিপুরন বাবদ রাজ্য শ্রমআইন অনুযায়ী এক বছরে ৩০০ দিনের মজুরীর টাকা দেওয়া হয়। এছাড়াও জমির বদলে ১০০ বর্গ মিটার বসত জমি। ২ একর জমি থাকলে পরিবার পিছু ক্ষতিপূরণ বাবদ একটি চাকরী। পুনর্বাসনের জমিতে নুন্যতম পরিকাঠামোর জল, বিদ্যুত, রাস্তা, নিকাশী, স্কুল স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরী করে দেওয়া হয়। জমি না নিলে তার জন্য ৪ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ কমপক্ষে সাড়ে ১২ লাখ টাকা পাবে উচ্ছেদ হওয়া পরিবার। যার চার কিস্তিতে ওই টাকা দেওয়া হবে। পুনর্বাসন প্রকল্পে চুড়ান্ত তালিকার জন্য গ্রাম কমিটি করা হয়েছে। ওই চুড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী উপভোক্তাদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সহ তালিকা যাচাই করে স্বাক্ষর করে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধান ও সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক। সম্প্রতি গ্রামে নতুন ভোটার লিস্ট আসতেই অনিয়মের পর্দা ফাঁস হয়। তাতে দেখা যায় দেড়’শ জন বহিরাগতের নাম নতুন লিস্টে। তাদের কেউ আসানসোল, কেউ ঝড়খন্ড কেউ বীরভুমের বাসিন্দা। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের টাকা তুলতেই বহিরাগতদের নাম তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে গেরুয়া শিবির।
বিজেপির পান্ডবেশ্বর ২ নং মন্ডল সভাপতি বেনুধর মন্ডল বলেন,” বড়সড় দুর্নীতি। শাসকদলের মদতে পুনরবাসনের গ্রাম কমিটি তৈরী করা হয়েছে। বহিরাগত আত্মীয় স্বজনদের নামে সুকৌশলে ভোটার, আধার কার্ড তৈরী করে পুনর্বাসন তালিকায় নাম তোলা হচ্ছে। তারপর জমি ছাড়া ক্ষতিপূরণের টাকা তাদের নামে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এবং সেখান থেকে মোটা টাকা কাটমানি নিচ্ছে নেতারা নেতারা। ইতিমধ্যে অনেকে প্রথম কিস্তির ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে গেছে। এই দুর্নীতিতে ইসিএলের আধিকারিকরাও জড়িত। তাই এই পুনর্বাসন প্রকল্পের দুর্নীতির সিবিআই ও ইডি তদন্তের দাবী জানাচ্ছি।” প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশন ও ইসিএলের ভুমিকায়। সরজমিন খতিয়ে যাচাই না করে কিভাবে একসঙ্গে দেড়’শ জনের নাম ভোটার তালিকায় নাম উঠল? কিভাবে সরজমিন তদন্ত না করে তাদের নাম ক্ষতিপুরনের তালিকায় উঠল তাদের নাম?
ইতিমধ্যে প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। তিনি ওই গ্রামে পরিদর্শন করে জানান,” আয়লা, ১০০ দিনের কাজের পর পুনরবাসন কেলেঙ্কারী। প্রায় দেড়’শ জন বহিরাগতের নামে পুনর্বাসন প্রকল্পের সুবিধা অনিয়ম করে আত্মসাৎ করছে তৃণমূল। গ্রামকমিটিতে তৃণমূলের নেতারা। তারাই তৈরী করছে ওই তালিকা। দুর্নীতিতে মমতা ব্যানার্জী পিএইচডি করেছেন। তার দলেরই নেতা কর্মীরা এই দুর্নীতিকান্ডে জড়িত। বিষয়টি কয়লামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে জানাচ্ছি। উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবী জানাচ্ছি।” যদিও এবিষয়ে ইসিএল কোন মন্তব্য করতে চায়নি। তবে ভাটমুড়া গ্রামের তৃণমূল সদস্য তথা গ্রাম কমিটির সদস্য তপন রুইদাস অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,” ঘর আছে, ইসিএলের ব্লাস্টিংয়ের জন্য থাকতে পারে না। বাইরে থাকে। সম্পুর্ন মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।”