-মিঠুন রায়
বছর ঘুরে এল সীতানবমী তিথি।মহাবতারী প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের আবির্ভাব তিথি। ১২৭৮ সনে পবিত্র সীতানবমীতে মুশিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জিয়াগঞ্জ থানাধীন ডাহাপাড়া গ্রামে অবতীর্ণ হন নিতাই-গৌর মিলিত তনু প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর।তিনি এসেছেন জীবের তরে।অনুগ্রহ করে মানুষের রূপ ধরে তিনি এসেছেন।অভিন্ন তার রূপ। বন্ধুসুন্দর রে স্বয় ভগবান তার,আজ আর যুক্তি দিয়ে ব্যাখা করতে হয় না। ভগবানের অস্তিত্ব তার নামের মধ্যেই বিদ্যমান।তাই প্রভু জগদ্বন্ধু বলেছেন-“তোরা হরিনাম কর। হরিনাম করে আমাকে তোদের সাথে মিশিয়ে নেয়।আমি হরিনাম,ভিন্ন আর কারও নই।”
নিজ পরিচয়ে একস্থানে প্রভু লিখিয়াছেন আমি একজন চিহ্নধারী পুরুষ মাত্র । ব্রজেন্দ্রনন্দনের যে যে লক্ষণ ছিল , তাহা আমাতে আছে । “ তাঁহার মধ্যে ভগবত্তার যে যে লক্ষণ ছিল , তাহার কয়েকটি বলিতেছি । তাঁহার বক্ষে ভৃগুপদ চিহ্ন ছিল ।
একদিন দিদি গোলোকমণি দেবী বন্ধু সুন্দরের শ্রীঅঙ্গের কাপড় খুলিয়া তৈল মাখাইতে যাইয়া ইহা দর্শন করেন । এই দৃশ্য দেখে তিনি বিস্ময়াবিষ্ট হন । তিনি জগদ্বন্ধু’র কাছে জানতে চান “ ওটি কিসের দাগ ? ” প্রভু বন্ধুহরি বলিলেন – “ দিদি , এই জন্যই তো বুকের কাপড় খুলি না । ইহাকে ভৃগুপদচিহ্ন কহে । ইহা একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের বক্ষে আছে ।
অতএব বন্ধুসুন্দর যে ভগবান তার আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।প্রভুর শ্রীচরণতলে ধ্বজ – ব্রজাঙ্কুশের চিহ্ন ছিল । বকুলাল বিশ্বাসকে দেখাইয়া ছিলেন । শ্রীপাদ মহেন্দ্ৰজী দেখাইয়াছিলেন , তিনি আমাকে দেখাইয়াছিলেন । শ্রীগৌরসুন্দরের চরণতলে ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন ছিল , তাহা গৌর – পার্ষদগণ কোথাও বলেন নাই । প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর বলিয়াছেন । তিনি শ্রীগৌরসুন্দরের বর্ণনায় বলিয়াছেন তোমরা চিনেছ কি ভাই , এ যে শচীর নিমাই , ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন সাক্ষী আছে রাঙ্গা পায়।
প্রভু দীর্ঘাকৃতি চারিহস্ত পুরুষ ছিলেন । এই কথা ‘ চন্দ্ৰপাত ‘ গ্রন্থে ও মহাকীর্তনের মধ্যে আত্মপরিচয়ে লিখিয়াছেন ।প্রভুর নিকট ছুটিয়া গিয়া দেখলেন যে , একটা বিরাট সাপ সমস্ত কেশরাশি জড়াইয়া ফণা বিস্তার করিয়া রহিয়াছে । ভক্তদের মনোভাব লক্ষ্য করিয়া প্রভু কহিলেন যে , আমার মাথার উপরে যেন জীব হত্যা না হয় । ভক্তদের একজন কিছুটা কাপড় জড়াইয়া নিয়া অতি সাবধানে সাপটিকে ধরিয়া নিয়া মাটিতে ফেলিয়া দিলেন । ভূমিতে পড়িয়া সঙ্গে সঙ্গে সর্পটি মৃত্যুবরণ করিল । অনন্তময়ের লীলা কে বুঝিবে ! ভগবান যখন মানুষ হইয়া আসেন তখন সেখানে যেমনটি প্রয়োজন হয় ,তেমনি লীলা করেন। কখনও ভক্ত , আর কখনও বা ভগবান বেশে। আবার কখনও সাধারণ মানুষ হইতেও সাধারণ অবস্হায় লীলা করেন। শূকর ভোজী বুনো – বাগ্দীদের প্রতি কেউ ফিরে তাকায় না। প্রভু হরিনাম দিয়ে প্রেম প্লাবনে তাদের আপন করে নেন । তাদের নবজীবন দান করেন । বুনোদের সর্দার রজনীর নাম দেন হরিদাস মোহন্ত । তাদের সম্প্রদায়ের নাম দিয়েছিলেন মোহন্ত সম্প্রদায়।আসলে লীলা ময়ের লীলা রহস্য বুঝবার সাধ্য কার আছে ।তিনি হরিনাম কে বলেছেন কল্যাণের বিধান।আমরা কল্যাণ চাই,সুখ চাই, শান্তি চাই, কিন্তু কিসে শান্তি হবে জানি না।প্রভু বলেছেন, একমাত্র হরি নামেই কল্যাণ ও শান্তি আসবে।
প্রভুর কপালে ছিল রাজটীকা চন্দ্রভাল । প্রভুর অন্তরঙ্গ ভক্ত শ্রীরমেশচন্দ্র দর্শন করেছিলেন । রমেশচন্দ্র কলকাতা মেস্ বাড়িতে থাকতেন । প্রভু মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন । একবার প্রভু রমেশের মেস বাড়িতে গিয়ে সোজা ছাদে উঠেছেন । পাশে রমেশ আছো । হঠাৎ প্রভু রমেশকে বললেন , “ রমেশ , এদিকে আয় , শোন্ । আমার মুখের দিকে তাকা তো । রমেশ বললেন , না প্রভু , আপনি না সেদিন মুখের দিকে তাকাতে বারণ করেছেন , “ আমার মুখের দিকে কখনও তাকাবি না । তোদের দৃষ্টিতে পাপ থাকে । ঐ পাপ দৃষ্টিতে তাকালে আমার কষ্ট হয় । ” প্রভু বললেন , “ আজকে তাকা । আজকে কিছু বলবো না । ” অনেকবার বলায় রমেশ তাকিয়ে দেখেন কপালে উজ্জ্বল কি যেন ঝলমল করছে । রমেশ বলে উঠলেন , প্রভু ! আপনার কাপলে ওটা কী ? প্রভু বললেন , “ এর নাম রাকাশশী , একে চন্দ্রভাল বলে । কৃষ্ণের কপালে পূর্ণ চন্দ্রভাল আর শিবের কপালে অর্ধ চন্দ্রভাল । আমার কপালে পূর্ণচন্দ্রভাল । ” এটাও একটি ভগবৎ – লক্ষণ । ভগবানের চরণে থাকে ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন , মহাপ্রভুরও ছিল । মহাপ্রভুর চরণে যে ছিল গোস্বামীপাদগণ তা জানাননি । কিন্তু প্রভুজগদ্বন্ধুসুন্দর জানিয়েছেন একটি পদে । প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর অনেক পদ রচনা করেছেন । রাধাকৃষ্ণের উপর ও নিতাই – গৌরের উপর । তারই একটা গানের পদ আছে “ তোমরা চিনেছ কি ভাই , এ যে শচীর নিমাই , ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ যে শ্রীপাদ মহেন্দ্রজী দেখিয়েছেন আমার শ্রীগুরুমহারাজ ড.মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজি কে। বকুলাল বিশ্বাসের কথা বলতে একটা প্রসঙ্গ মনে হ’ল । বকুলাল বিশ্বাস একবার আমার গুরুদেবকে ডেকে বলছেন যে , শোন্ পুরুষ মেয়েদের পিছনে ছোটে এটা সবাই জানে । কিন্তু পুরুষ লোক পুরুষের পিছনে ছোটে এটা শুনেছিস্ কোনদিন ? এই যে আমরা , পাঁচ – সাতটা ছেলে আছি । আমরা প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরকে দর্শন না করে থাকতে পারতাম না । কিছুক্ষণ কাজ করছি হঠাৎ মনে হ’ল প্রভুকে তো দেখলাম না । আবার প্রভুর কাছে যাই । সারাদিন যে কতবার প্রভুকে দর্শন করতাম তা কোন হিসেব ছিল না । এমন একটা আকর্ষণ ছিল প্রভুর রূপের ও তাঁর কথাবার্তার ভঙ্গিতে যে আমরা আকৃষ্ট হয়ে প্রভুকে দর্শন করতে যেতাম ।
সংকটময় সময়ে প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর সরল ভাষায় প্রেমের ঠাকুর নিত্যানন্দের এবং শ্রী রাধাকৃষ্ণের সুমধুর লীলা কথা অভিনব ছন্দে ও রাগ-রাগিনীতে কীর্তনের জন্য পদাবলী রচনা করেন।ঠাকুরের কীর্তনীয়া গোপাল মিত্র প্রভু বন্ধুসুন্দরের কীর্তন গান প্রথম প্রচারে উদ্যোগী হন।প্রভু নিজেই তার রচনায় সুর দিয়েছেন। হরিনাম প্রচারিত দয়াল বন্ধুহরির মূল উদ্দেশ্য ছিল। হরিনাম প্রচারের জন্য তিনি সাতটি সম্প্রদায় তৈরি করেছিলেন।১৯০২ সনে প্রভু ষোল বছর আট মাস মহাগম্ভীরায় ছিল।মৌন ভঙ্গের পর ১৯২১ সালে আশ্বিন মাসে তিনি লীলা সংবরণ করেন।
শুভ আবির্ভাব তিথিতে প্রেমের অবতার বন্ধুসুন্দরের রাঙ্গাচরণে আমার বিনম্র প্রাথনা –
“আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণ ধূলার তরে”।
জয় জগদ্বন্ধু।জয় শ্রী গুরুদেব।