BRAKING NEWS

ত্রিপুরায় উপজাতি দলগুলি বুদ্বুদের মত হারিয়ে যায়, সংকীর্ণতা বিড়ম্বিত করেছে উপজাতিদের ভাগ্য

।। পরিতোষ বিশ্বাস।। 

ত্রিপুরায় এখন পর্যন্ত যেসব উপজাতি দলের জন্ম হয়েছে তার মধ্যে উপজাতি যুব সমিতি জাতিয়তাবাদী মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ ছিল৷ অন্যান্য উপজাতি দলগুলি উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছে৷ যুব সমিতির মধ্যে তেমনটা ছিল না৷ যুব সমিতি পৃথক রাজ্যের দাবী তুলেছিল৷ রাজ্যের মধ্যে রাজ্য, ষষ্ঠ তপশিলের দাবী করেছিল এডিসিতে৷ কিন্তু, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি তেমন ছিল না৷ যুব সমিতির এই অবস্থানকে নতুন গজিয়ে উঠা উপজাতি উগ্র দলগুলির পছন্দের হয়নি৷ নতুন যেসব দল গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে উপজাতি ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনীতির পথে হেটেছে৷ এরাজ্যে উগ্রপন্থী দলের অঙ্গুলি নির্দেশেও কোনও কোনও উপজাতি দল পরিচালিত হত বলে অভিযোগ ছিল৷ জোট সরকারের আমলে যুব সমিতির মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দর কষাকষি চলত৷ কিন্তু, পাহাড়ী বাঙালীর মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণকে তারা মূল্য দিত৷ এই সত্যিকে বোধহয় অস্বীকার করা যাবে না৷ জোট সরকারের আমলে কৃষিমন্ত্রী নগেন্দ্র জমাতিয়া বিভিন্ন উপজাতি গ্রাম পাহাড় চষে বেরিয়েছেন৷ আমিও তাঁর অনেক সফরের সঙ্গী ছিলাম৷ উপজাতি মহল্লায় রাত কাটিয়েছি৷ উপজাতি পরিবার আমাদের আপ্যায়িত করেছে৷ পায়ে হেটে বিভিন্ন গণহত্যার স্থান দেখতে পেয়েছি৷ বিভিন্ন পাহাড় গ্রাম চষে সাত-আট দিন পর রাজধানীতে ফিরে আসতাম৷ এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে তুলে ধরার চেষ্টা করব৷ শারীরিকভাবে আমি খুবই দূর্বল৷ লেখার ক্ষমতা নেই৷ তবুও কষ্ট করে কিছু তথ্য তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করি৷ শয্যাশায়ী ডায়ালাইসিস রোগীর পক্ষে এই লেখা কত কঠিন, কষ্টসাধ্য৷ আর এই জন্যই লেখার ছন্দপতন ঘটতে পারে৷ এজন্য আমি ক্ষমা চাই৷ উগ্রপন্থী সমস্যা ত্রিপুরাকে অনেক পিছনে ঠেলে দিয়েছে৷ পিছনে ঠেলে দিয়েছে উপজাতিদেরও৷ গোটা রাজ্য ছিল সন্ত্রস্ত৷ গ্রাম পাহাড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল৷ আসাম আগরতলা জাতীয় সড়ক উপদ্রুত হয়ে পড়ে৷ সেখানে পরিবহণ ব্যবস্থায় চালু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর এসকর্ট৷ এক অন্ধকারময় জগৎ ত্রিপুরার ভাগ্যকে নির্মম ভাবে বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেয়৷ যারা একদিন স্বাধীন ত্রিপুরার দাবীতে রাজ্যে রক্তের বন্যা বহাইয়াছে, যারা উপজাতিদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, ত্রিপুরার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে-তাদের তো বিচার হয়নি৷ তারা পুরসৃকত হয়েছে৷ ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে৷ কিন্তু ত্রিপুরার যে সর্বনাশ হয়ে গেল৷ শিক্ষা সবদিক থেকে পিছিয়ে গেল উগ্রপন্থার কারণে৷ তার সেই ক্ষতির মোকাবিলা কি করা হয়েছে? ত্রিপুরায় দীর্ঘ রাজন্য শাসনে উপজাতিদের ভাগ্য উন্নয়নে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল? উপজাতিরা সেদিন বঞ্চিতই ছিল৷ শিক্ষা আলো থেকে তারা অনেক দূরে৷ রাজ প্রশাসন পরিচালনার জন্য বাঙালীদের ডেকে আনা হত৷ রাজন্য আমলে রাজ আনুকূল্যে যে রাজমালা লেখা হেয়েছে সেটিও বাংলাতে৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রাজ আমন্ত্রণে ত্রিপুরায় এসেছিলেন৷ এই ইতিহাস গর্বের৷ রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরাকে অনেক উপহার দিয়েছেন৷ বিসর্জন নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি রাজ অন্তপুরের দুঃখ-বেদনা হাসি-কান্না তুলে ধরেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরাকে বিশ্ব আঙ্গিনায় নিয়ে গেলেন৷ বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ত্রিপুরার মহারাজার আনুকূল্য পেয়েছিলেন৷ বাঙালী কৃষ্টি সংসৃকতির সঙ্গে মহারাজের নিবিড় সম্পর্ক-তো ইতিহাস সত্য৷
দেশ বিভাজনের পর ত্রিপুরা কোন দেশে যোগ দেবে তা নিয়ে টানাপোড়েন চলে৷ এর আগেই মহারাজ বীরবিক্রম প্রয়াত হন৷ কীরিট বিক্রম মাণিক্য বাহাদূর তখন নাবালক৷ তিনি রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না৷ তাই মহারাণী কাঞ্চনপ্রভা রাজ্য চালাতেন৷ এই রিজেন্ট মহারাণী ভারতবর্ষে ত্রিপুরাকে যোগ দেওয়ার ঘোষণা করেন৷ ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার মহারাণী ভারতভুক্তিতে স্বাক্ষর করেন৷ এখানে প্রশ্ণ উঠতে পারে রাজার রাজত্বের আয় কি ছিল? আয় ছিল চাকলা রোশনাবাদের প্রজাদের থেকে আদায়কৃত কর৷ চাকলা রোশনাবাদ ত্রিপুরার রাজার অধীনে ছিল৷ ইংরেজ সরকার রেল লাইন ও অন্যান্য ব্যবসার খাতিরে চাকলা রোশনাবাদ তাদের দখলে নিয়ে নেয়৷ শর্ত থাকে মহারাজা এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে পারবেন৷ ত্রিপুরার মহারাজকে ইংরেজদের তোষণ করে চলতে হত৷ ইংরেজকে কর দিতে হত৷ কর দিয়ে মিত্রতা৷ এজন্য ত্রিপুরাকে করদমিত্র রাজ্য বলা হত৷ ভারতভুক্তির সময় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেখানেও অনেক শর্ত ছিল৷ রাজশাসন দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন মন্দির সরকারকে পরিচালনা করার শর্ত চুক্তিতে ছিল৷ তাই ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, কসবা মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির সবগুলি এখন ত্রিপুরা সরকারের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত হচ্ছে৷ ত্রিপুরায় বাঙালী জনগোষ্ঠীর আগমন শুধু দেশ বিভাগের কারণেই হয়নি৷ রাজন্য শাসনের ক্ষেত্রে শিক্ষিত বাঙালী অংশের মানুষের প্রয়োজন অনুভব করতেন মহারাজা স্বয়ং৷ পাকিস্তান থেকে বহু মানুষকে শুধু ত্রিপুরায় নয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পুনর্বাসিত করা হয়৷ খোদ রাজধানী দিল্লীতেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য সরকার থাকার ব্যবস্থা করে দেন৷  বাঙালী অংশের মানুষের আগমন ত্রিপুরায় উপজাতি অংশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তেমন উগ্র রূপ নেয়নি৷ ষাটের দশকের পর থেকেই উপজাতিদের মধ্যে বিভাজনের বিষ ঢালা শুরু হয়৷ এখানে বাঙাল খেদাও আন্দোলনও ছড়িয়েছে৷ পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের এরাজ্যে প্রবেশে বাধাও দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু, জনঢল আটকাবে কে৷ ধীরে ধীরে ত্রিপুরায় বাঙালী অংশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা দেয়৷ কিন্তু চাকলা রোশনাবাদ এলাকা ধরলে রাজার রাজত্বেই বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিল বলে তথ্য রয়েছে৷ সারা রাজ্যে বাঙালীদের হাতে চাষাবাদ, ব্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়৷ এইভাবেই নতুন ত্রিপুরা গড়ে উঠে৷ উপজাতিদের মধ্যে বিদ্বেষের আগুন ছড়াতে কারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ত্রিপুরার মানুষ তা ভালই জানেন৷
উপজাতিদের উন্নয়নে অনেক সাংবিধানিক সুবিধা দেয়া আছে৷ সরকারী চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ থাকার সুবাদে উপজাতি ছেলেমেয়েরা নিজেদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷ উপজাতিদের কোনও আয়কর দিতে হয় না৷ এই সুবিধাগুলি উপজাতিদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অনেক বেশী সহায়ক তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না৷ তবুও, উপজাতিদের কল্যাণে আরও কিছু করা দরকার৷ যারা এখনও অর্থনৈতিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন তাদেরকে আরও বেশী সহায়তা দিয়ে কিভাবে তাদের এগিয়ে নেয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে৷ উপজাতিদের সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনীতি উপজাতিদের কল্যাণ আনে না৷ অতীতের রক্তস্রোতের ঘটনা, এই সত্যিটাই সামনে এনে দেয়৷ (চলবে)   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *