BRAKING NEWS

ত্রিপুরায় উপজাতি দলগুলি বুদ্বুদের মত হারিয়ে যায়, ভাবাবেগ দিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধিত হয় না

পরিতোষ বিশ্বাস

উপজাতিদের নিয়ে রাজনীতির চরম মূল্য ত্রিপুরাবাসীকে দিতে হয়েছে৷ আমি আশি সালের ঘটনাতে আবার ফিরে যেতে চাই এই কারণে যে, উপজাতি রাজনীতি কত নির্মম, নৃশংস তা তুলে ধরতে৷ ওই বছরের জুন মাসে লেম্বুছড়া বাজারে সামান্য আনারস বিক্রিকে কেন্দ্র করে নিমিষে অগ্ণোৎপাত ঘটে যায় সারা রাজ্যে৷ নির্বিচারে গণহত্যা চলে৷ বহু পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে৷ মান্দাইয়ে শত শত লোককে হত্যা করা হয়৷ দেয়া হয় গণকবর৷ উপজাতি রাজনীতির এই দুঃখজনক, মর্মান্তিক ঘটনা ত্রিপুরায় কালো অধ্যায় হয়ে আছে৷ সিপিএম শাসিত রাজ্যে এত বড় দাঙ্গা হয়ে গেল৷ এই দাঙ্গায় কারা জড়িত, কাদের ইন্ধনে হয়েছে তার তদন্তে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী উঠেছিল৷ মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর দম্ভোক্তি ছিল, আমি থাকতে আশি সালের দাঙ্গার কোন তদন্ত হবে না৷ অরণ্য বেষ্টিত ত্রিপুরায় রাজন্য আমল থেকেই পাহাড়ি বাঙালী সখ্যতা বিরাজমান ছিল৷ এখানে আমার নিজের কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না মনে হয়৷ আমার জন্ম হয়েছিল অধুনা ধলাই জেলার পাহাড় বেষ্টিত কুলাই গ্রামে৷ তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়৷ নদীপথে, হাতির পিঠে চড়ে মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হত৷ এই কুলাই গ্রামে আমিই প্রথম বাঙালী সন্তান জন্মগ্রহণ করি৷ সেই পঞ্চাশের দশকে, আমার যখন শৈশব তখন আমি দেখেছি, আমার মনে পড়ছে পাহাড়ে উপজাতি পরিবার আমাকে নিয়ে যেত তাঁদের টং ঘরে সারাদিন রেখে আবার সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরিয়ে দিতেন৷ এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি৷ সেই সময়ের উপজাতি ও অউপজাতিদের মিতালি কেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল৷ সেটা ভাববার বিষয়৷ ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতি উপজাতির সম্প্রীতির মেলবন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করার কোনও চেষ্টা ত্রিপুরাবাসী মেনে নেবে না৷ বামফ্রন্ট শাসনে ত্রিপুরায় একের পর এক উগ্রপন্থী সংগঠনের জন্ম হতে থাকে৷ আর চলে আত্মসমর্পণের নাটক৷ অনেক জঙ্গী আত্মসমর্পণ করে সিপিএমে যোগ দিয়েছে৷ এই সত্যিকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই৷ উগ্রপন্থীর হাতে নিহতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও টানাটানি চলত৷ এই বিভৎস দিনগুলি ত্রিপুরাবাসী ভুলে যায়নি৷ সেই অভিজ্ঞতা, সেই শিক্ষা আগামীদিনে জাতি উপজাতির সম্প্রীতির মেলবন্ধনকে আরও বেশী শক্তিশালী করবে৷ এটি প্রতিটি ত্রিপুরবাসীর ইচ্ছা৷ স্বাধীন ত্রিপুরার দাবীতে ত্রিপুরায় উপজাতিদের মনে যে বিষ ঢেলে দিয়েছিল পরবর্তী সময়ে উপজাতি অংশের মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন৷ স্বাধীন ত্রিপুরার দাবীর পক্ষে জেনেভা সম্মেলনে টিএনভি অধিনায়ক প্রাক্তন উগ্রপন্থী দলের সর্বাধিনায়ক বিজয় রাঙ্খল সওয়াল করেছিলেন৷ সিপিএম দল সেটা লুফে নেয় এবং থানায় রাঙ্খলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷ রাঙ্খলের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিংয়ের তুফান ছুটে৷ কিন্তু, কিছুদিন যেতে না যেতেই সিপিএমের সেই বিপ্লবী চেহারা বদলে যায়৷ ত্রিপুরায় উপজাতিদের নিয়ে প্রতিটি উপজাতি দল মায়াকন্নাই করে গিয়েছে৷ উপজাতিদের পিছিয়ে থাকার পিছনে উপজাতি নেতারাই সবচেয়ে বেশী দায়ী৷ আজ এডিসির অবস্থা কি? দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ ক্রমাগত বাড়ছে৷ সিপিএম যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এডিসি উপজাতিদের জীবনে আশার আলো দেখাতে পারেনি৷
১৯৮৮ সালে ত্রিপুরায় বামফ্রন্টের দীর্ঘ রাজত্বের অবসান হয়৷ কংগ্রেস উপজাতি যুব সমিতি জোট সরকার প্রতিষ্ঠা পায়৷ মুখ্যমন্ত্রী হন কংগ্রেসের সুধীর রঞ্জন মজুমদার৷ ইতিহাসের নির্মম ঘটনা এটাও যে কংগ্রেস নেতা দীর্ঘদিনের সভাপতি ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য অশোক ভট্টাচার্য্য মুখ্যমন্ত্রী হতে পারলেন না৷ মুখ্যমন্ত্রী হলেন তাঁরই শিষ্য সুধীর রঞ্জন মজুমদার৷ কেন অশোকবাবুর কপালে রাজ তিলক জুটল না? কেন ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত বিমুখ হলেন? তার পেছনে উপজাতি ইস্যু কাজ করেছে৷ অশোক ভট্টাচার্য্য দীঘদিন হয়েছে প্রয়াত হয়েছেন৷ কংগ্রেসের চরম দুর্দিনে জয়নগরে বকুলতলায় মোমবাতি জ্বালিয়ে দলকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন৷ সেই অশোক ভট্টাচার্য্য রাজনৈতিক জীবনে ত্রিপুরা উপজাতি এলকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ  (টিটিএডিসি) গঠনে তীব্র বিরোধীতা করেছেন৷ বলেছেন, রাজ্য সরকারের পক্ষেই উপজাতিদের উন্নয়ন সম্ভব৷ এডিসি পত্তন করে কিছু লোকের পুনর্বাসন হতে পারে, উপজাতিদের উন্নয়ন হবে না৷ একই সুরে কথা বলেছিলেন জোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কাশিরাম রিয়াং৷ এই এডিসি বিরোধীতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুব সমিতি তাঁকে উপজাতি বিদ্বেষী বলে অভিহিত করে৷ ফলে নির্বাচনে জেতার পর যুব সমিতি স্পষ্ট জানিয়ে দেয় অশোক ভট্টাচার্য্যকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলে তারা সরকারে থাকবে না৷ যুব সমিতির এই প্রতিক্রিয়ায় ভাগ্য খুলে যায় সুধীর রঞ্জন মজুমদারের৷ তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়৷ সুধীর মজুমদার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে স্বস্তিতে দিন কাটাতে পারেননি৷ কারণ উপজাতি যুব সমিতি৷ একের পর এক বায়না যুব সমিতি করতে থাকে৷ আর বায়না না মিটলে সমর্থন তুলে নেয়ার হুমকি চলে৷ উপজাতি এলাকায় কংগ্রেস কোন সংগঠন করতে চাইলে যুব সমিতি ক্ষেপে উঠে৷ মুখ্যমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারী দেয়৷ উপজাতি এলাকায় কংগ্রেস কোন সংগঠন করতে পারবে না, আমরা একাই রাজত্ব করব৷  কংগ্রেসের উপজাতি নেতারা উপজাতি সংগঠন বিস্তারের চেষ্টা করলেই মুখ্যমন্ত্রী সুধীর রঞ্জন মজুমদার সেখানে বাধা দিতেন৷ ফলে উপজাতি এলাকায় কংগ্রেসের কোনও সংগঠন খঁুজে পাওয়া যাবে না৷ শচীন সিংয়ের আমল থেকে  ত্রিপুরায় উপজাতি এলাকায় কংগ্রেসের আধিপত্য যতখানি ছিল তা নিমেষে তছনছ হয়ে যায়৷ কংগ্রেস উপজাতি এলাকা থেকে হারিয়ে যায়৷ উপজাতি এলাকায় কংগ্রেসের কোন সংগঠন নেই৷ এর জন্য দায়ী কংগ্রেস যুব সমিতি জোট৷ উপজাতি দলের সাথে অন্যান্য দলের জোট সরকারের অভিজ্ঞতা কি ভয়ানক সেটা রাজ্যের মানুষ দেখেছে৷ আঠার-র নির্বাচনে যদি বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল না হত তাহলে আইপিএফটি যুব সমিতির মতো ছড়ি ঘুরাত৷ সমর্থন তুলে নেয়ার হুমকি দিত না এমন গ্যারান্টি কি ছিল?
কংগ্রেস যুব সমিতির জোটের রাজত্ব ত্রিপুরার মানুষের মনে দুঃখ ও বেদনার ছাপ রেখেছে৷ সিপিএমের দীর্ঘ শাসনের অবসান হয়েছিল গভীর প্রত্যাশা নিয়ে৷ কিন্তু, জোট রাজত্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজ্যের মানুষকে আহত করেছে৷ কথায় কথায় সমর্থন তুলে নেয়ার হুমকি দিয়ে যুব সমিতি যে নজির রেখেছে তাতে আগামীদিনে রাজনীতিতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে৷ সুধীর মজুমদারের রাজত্বে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলাও ভালো ছিল না৷ যুব সমিতি সুধীর মজুমদারের উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলে৷ একসময় যুব সমিতি সিপিএমকে নিয়ে সরকার গড়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল৷ শর্ত ছিল দশরথ দেবকে সিপিএম পার্টির রাজ্য সম্পাদক করতে হবে৷ সিপিএম রাতারাতি দশরথ দেবকে রাজ্য সম্পাদক করে৷ কিন্তু, যুব সমিতি সেখান থেকে পিছু হটে৷ তারা সুধীর মজুমদারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়৷ সুধীর মজুমদার পদত্যাগ করেন৷ সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতারা ছুটে আসেন৷ সমীর রঞ্জন বর্মনকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দেয় যুব সমিতি৷ সমীর বর্মন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যে দলের ও সরকারের কি হাল করেছিলেন সেটা রাজ্যবাসীর ভালই জানা আছে৷ ত্রিপুরায় উপজাতিদের দরদ দেখাতে গিয়ে বিভিন্ন উপজাতি দল বিভিন্ন ইস্যুতে আত্মপ্রকাশ করে৷ যেমন স্বাধীন ত্রিপুরা, এডিসি, এডিসি এলাকায় পৃথক রাজ্য, ষষ্ঠ তপশিল, এবার এসেছে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড৷ উপাজাতিদের নিয়ে দাবীর পর দাবী রয়েছে৷ তাদের ভাগ্য একেবারেই তিমিরে রয়ে গিয়েছে বলা যাবে না৷ এখনও পাহাড়ে একশ্রেণীর উপজাতিরা যেমন ছড়ার জল পান, করে অপুষ্টিতে ভোগে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়৷ অন্যদিকে এরাজ্যে বহু উপজাতি অংশের মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় অগ্রণী হয়েছে৷ ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আধিকারীক পদে প্রতিষ্ঠা হয়েছে৷ উপজাতি অংশের মানুষের এই অগ্রগতিকে ছোট করে দেখার কোন উপায় নেই৷ (চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *