BRAKING NEWS

পায়ে পায়ে ৭৫, এগিয়ে চলেছে ‘হিন্দুস্থান সমাচার’

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি আর স্বাধীন ভারতের প্রাচীনতম সংবাদ সংস্থার ৭৫ বছর— এই যুগলবন্ধনকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় হিন্দুস্থান সমাচার। সম্মেলনের মূল মন্ত্র হিসাবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পঞ্চপ্রণ তত্বটিকে। 

ভারতের উন্নয়নের লক্ষ্য, ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্তি, আমাদের শিকড়ের প্রতি গর্ব, একতা এবং দায়িত্বের চেতনা— এই পাঁচটি মন্ত্র জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়ার আবেদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির সমাবেশে এই অঙ্গীকারের কথা বলেছিলেন তিনি। 

স্বাধীনতার ঠিক পরে, ১৯৪৮ সালে যাত্রা শুরু করে হিন্দুস্থান সমাচার। মূল মন্ত্র ছিল দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদ। আগামী ২১ ডিসেম্বর প্রয়াগরাজে চর্চা হবে এই সাড়ে সাত দশকের ফেলে আসা কাজ ও আগামীর পথ চলা নিয়ে। প্রধান অতিথি থাকবেন অযোধ্যা ‘হনুমান নিবাস’-এর মহন্ত আচার্য মিথিলেশ শরণ জী, মুখ্য বক্তা হিমাচল প্রদেশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য কুলপতি চন্দ্র অগ্নিহোত্রী, সভাপতি থাকবেন হিন্দুস্থান সমাচার-এর অধ্যক্ষ অরবিন্দ বালচাঁদ মাদ্রেকার, বিশিষ্ট অতিথি ‘গঙ্গা সমগ্র’-র রাষ্ট্রীয় মহাসচিব তথা হরিদ্বারের ‘দিব্য প্রেম সভা মিশন’-র সংস্থাপক আশিস ভাইয়া। বিশেষ অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের কাশী প্রান্তর সহ প্রান্ত সহায়ক মুনীষ কুমার। প্রয়াগরাজে জর্জটাউনে জগৎ তাড়ন গোঢ়্ডেন জুবিলি ইস্টার কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাগৃহে হবে প্রস্তাবিত সম্মেলন। 

কীভাবে উদ্ভব হল ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর? দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। কেউ কেউ চাইছিলেন জাতীয়তাবাদের আদর্শে পরিচালিত হোক সংবাদজগৎ। ইউনাইটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সাংবাদিক, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শিবরাম শঙ্কর (দাদাসাহেব) আপ্তে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দুস্থান সমাচার। ১৯৪৮ সালে এটি একটি কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত হয়। ১৯৫৬ সালে একটি সমবায় সমিতিতে পরিবর্তিত হয়৷ এই পরিবর্তনের সাথে, হিন্দুস্থান সমাচার-এর সমস্ত কর্মী এর শেয়ারহোল্ডার হয়ে ওঠে৷

হিন্দুস্থান সমাচার-এর প্রধান সম্পাদক রাম বাহাদুর রাই ‘নিউজলন্ড্রী’-তে এক সাক্ষাৎকারে (২৭-১১-২০১৮) জানান, “আমি ১৯৭৯ সালে এই সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলাম। বালেশ্বর আগরওয়াল তখন এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি প্রতিটি কর্মীকে ১০০ টাকার শেয়ারহোল্ডার করতেন। পরিমাণটা অনেক বেড়ে গেছে। আজ, প্রত্যেক ব্যক্তিকে ₹১০,০০০ শেয়ারহোল্ডার করা হয়েছে।” ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে এই সংস্থার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন যে এটি প্রতিষ্ঠানের ‘সুবর্ণ সময়’ ছিল। 

রাম বাহাদুর রাই উল্লেখ করেছেন, “ওই সময়ে, সংস্থার অফিস দিল্লির কনট প্লেসের ফায়ার ব্রিগেড লেনে ছিল, তিনটি বড় বাংলোতে সদর দফতর। দিল্লি ছাড়াও, সংস্থার অফিস জয়পুর, মুম্বাই এবং ভোপালে ছিল। প্রত্যেক নতুন কর্মচারীকে প্রশিক্ষণের জন্য এই চারটি শহরের একটিতে পাঠানো হত।“ সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন প্রথমবারের মতো দেবনাগরী লিপিতে টেলিপ্রিন্টার শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় সফলভাবে শুরু হয়। 

সংস্থার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষে ২০০৭-এর ৯ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ফিকি প্রেক্ষাগৃহে বক্তৃতা দেন আরএসএস-এর মোহন ভাগবৎ। তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে ‘অর্গানাইজার’ লিখেছে, “He said the unhealthy competition developed among various media institutions would take the country nowhere. In such circumstances the challenge for the responsible media institutions has increased and they have to combat the growing commercialisation in this important sector. 

Media has the responsibility to educate the society. If the present trend of commercialisation continues what will happen to the country? The wrong and misleading information published by a section of the media to please some vested interests sometimes develop hatred even towards the great personalities of the country, he added. He appealed to the journalists to understand their responsibility and look at the problems of the common man. He stressed the need to propagate Indian languages.“

মোহন ভাগবৎ ওই সমাবেশে বলেন, “যে উদ্দেশ্যে হিন্দুস্থান সমাচার ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা চিরন্তন। দেশের এমন গণমাধ্যম দরকার যারা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে। আজকে দৃশ্যটা ভালো না। আমরা এটা পরিবর্তন করতে হবে। দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে তা প্রমাণিত হয়েছে। “ (’অর্গানাইজার, ২৩-১২-২০০৭)। 

২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত হিন্দুস্থান সমাচারের সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন আশুতোষ ভাটনগর। তিনি বলেছেন, “স্বাধীনতার সময় দেশে কোনও ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ছিল না। হিন্দুস্থান সমাচার প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি সর্বভারতীয় সংস্থা তৈরি করা উচিত যা আঞ্চলিক ভাষায়ও কাজ করবে।” এটি প্রতিষ্ঠার পরপরই, বিহার সহ রাজ্য সরকারগুলি একে একে এর গ্রাহক হতে শুরু করে।  সারা দেশে তার উপস্থিতি তৈরি করতে শুরু করে হিন্দুস্থান সমাচার। 

শুরুতে এজেন্সির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আঞ্চলিক ভাষায় সংবাদ প্রদানের একমাত্র সংবাদ সংস্থা। এটির সম্প্রসারণের পিছনে একটি চালিকা শক্তি ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে, শত শত ছোট সংবাদপত্র এর গ্রাহক হয়ে ওঠে। তবে, জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলি এখনও দূরত্ব বজায় রেখেছে।

রাম বাহাদুর রাই ‘নিউজলন্ড্রী’-তে এক সাক্ষাৎকারে 

বলেছেন, “আমি একবার ‘জনসত্বা’-র প্রাক্তন সম্পাদক ওম থানভির সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ‘রাজস্থান সমাচার’ থেকে তাঁর সাংবাদিকতার পেশা শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে, ‘রাজস্থান সমাচার’ হিন্দুস্থান সমাচার-এর উপর এতটাই নির্ভরশীল ছিল যে যদি এই সংস্থাটি না থাকত, তাহলে পত্রিকাটি প্রকাশ করা কঠিন হয়ে যেত। ওম থানভির এই বক্তব্য থেকে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে সেই সময়ে হিন্দুস্থান সমাচার-এর পরিষেবা কতটা বিস্তৃত ছিল।” 

২০১৬ সালে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীতে মহা কুম্ভ মেলার তুঙ্গে ছিল। তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মধ্যপ্রদেশের নিনোরাতে আরেকটি ‘আদর্শ মহা কুম্ভ’ আয়োজন করে। ওই তিন দিনের অনুষ্ঠানে সঙ্ঘের অনেক বড় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এবং সরকারীভা (সাধারণ সম্পাদক) ভাইয়াজি জোশী। সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। 

সেই সময়ে ইন্ডিয়া টুডে-তে রিপোর্ট করা হয়, সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরে রাজ্যসভার সাংসদ এবং উদ্যোগপতি আর কে সিনহাকে অবিলম্বে অনুষ্ঠানে আসার জন্য একটি বার্তা পাঠান। বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে সিনহা নিনোরায় পৌঁছে ভাইয়াজি জোশীর সাথে দেখা করেন। জোশী তাঁকে বলেন, “সঙ্ঘ নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে হিন্দুস্থান সমাচারের দায়িত্ব আপনাকে হস্তান্তর করতে হবে।” 

হিন্দুস্থান সমাচার সেই সময়ে দিল্লির বাইরে একটি স্বল্প পরিচিত সংবাদ সংস্থা ছিল। সিনহা কোনো দ্বিধা বা প্রশ্ন ছাড়াই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। কয়েকদিনের মধ্যে সিনহাকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এইচএস-এর চেয়ারম্যান হিসাবে সিনহার অধিগ্রহণ এই অজানা সংবাদ সংস্থার সুদিনের সূচনা হিসাবে চিহ্নিত হয়। দেশের প্রাচীনতম বহুভাষিক সংবাদ সংস্থা হওয়া এরা সত্ত্বেও এএনআই-এর সমর্থন পাচ্ছিল না। 

রবীন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব নেওয়ার পর, এর অফিস পাহাড়গঞ্জের সরু রাস্তা থেকে নয়ডা সেক্টর ৬৩-এর একটি বড় ভবনে স্থানান্তরিত হয়। কর্মীদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, বাজারে এটি নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। শীঘ্রই, সরকারী নীতিগুলিও এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যা সংগঠনের সম্প্রসারণের জন্য অনুকূল প্রমাণিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি  আরএসএস মতাদর্শের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। শুধুমাত্র দেশের বৃহত্তম সংবাদ সংস্থা হওয়ার স্বপ্নই দেখছিল না, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে দ্রুত এগিয়ে চলার চেষ্টা করে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এসেছে এই সংস্থার কথা। ২০১৭-র ১৫ জুলাই ‘দি ওয়্যার’ মণীষ তিওয়ারির সংশ্লিষ্ট টুইটের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, “After having brought the larger part of the media into submission, the only thing left was to control the news feeds. The instructions do not come in writing from the government. The top officers of Prasar Bharati have already been told to replace PTI and UNI with Hindusthan Samachar.”

‘দি ওয়্যার’ লিখেছে, “A Hindustan Times report said that the agency, in its declared mission to present news from a “nationalist” perspective, is set to raise its subscription charges soon. It added that in its plan to expand its reach, the agency will move to a “swanky” office in Noida from its current address in Paharganj, right next to the RSS’s office in New Delhi.

The agency has benefitted from the BJP-led governments at the Centre in the past too. After having faced fierce attacks during the Emergency in the 1970s, the agency was forced to shut shop in 1986. But the RSS revived it in 2000 during Atal Bihari Vajpayee’s tenure as prime minister.

If it lands government contracts now, like Prasar Bharati’s subscription, its finances will likely to receive a great boost.”

হিন্দুস্থান সমাচার ১৪টি ভাষায় কাজ করে: হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, নেপালি, ওড়িয়া, অসমীয়া, কন্নড়, তামিল, মালায়লাম, তেলেগু, সিন্ধি, সংস্কৃত, পাঞ্জাবি এবং বাংলা। এটি সারা দেশে শত শত সংবাদপত্রের খবর সরবরাহ করে। ক্রমে এই সংস্থা এবং প্রসার ভারতীর মধ্যে একটি ‘চুক্তি‘ হয়। দূরদর্শন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সংবাদের প্রধান উৎস হয় সংস্থাটি। 

কয়েক দশক পুরনো সংস্থার এই দ্রুত রূপান্তর কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে— এর মানে কি আরএসএস খবরের জগতে তার পদচিহ্ন স্থাপন করার চেষ্টা করছে, যেমনটি শিশু মন্দির ও বিদ্যা মন্দিরের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় করেছিল? সমাচারের কী পরিবর্তন হয়েছে, যা বহু বছর ধরে কার্যত সুপ্ত ছিল? এটি কতজন লোককে নিয়োগ করে, কতগুলি রাজ্যে এটির শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এবং এর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের একটি দ্রুত নজর এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

অনেকে বলেন, হিন্দুস্থান সমাচারে আরএসএস-এর সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের আধিপত্য দেখেছেন। এর কর্মধারা সংঘের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের মতো। তবে এর প্রাক্তন সম্পাদক আশুতোষ ভাটনাগর বলেছেন, “এই বিশ্বাস সঠিক নয়। সরোজিনী মহিষী এবং হরেকৃষ্ণ মাহাতাবের মতো ব্যক্তিরাও ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর চেয়ারপারসন হিসেবে কাজ করেছেন। এঁরা জনতা পার্টি এবং কংগ্রেসের বড় নেতা ছিলেন, যাদের আরএসএসের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।“

রবীন্দ্র কুমার সিনহা ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর দায়িত্ব ত্যাগ করার পর ২০২২-এর ২৩ এপ্রিল সংস্থার নয়া চেয়ারম্যান মনোনীত হন প্রযুক্তিবিদ অরবিন্দ মার্দেকার। পেশাদারি মনোভাব নিয়ে অভীষ্ঠ লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ৭৫-এ পা দেওয়া এই সংবাদ সংস্থা। 

সূত্র— রাহুল কোটিয়াল, ‘দি টেকঅফ অফ হিন্দুস্থান সমাচার উইথ এ লিটল হেল্প ফ্রম আরএসএস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’/ ‘নিউজলন্ড্রী’ (২৭-১১-২০১৮)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *