করিমগঞ্জ (অসম), ২৯ মার্চ (হি.স.) : কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে রাজ্য সরকার নিরলস প্রয়াস জারি রেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং কৃষিমন্ত্রী অতুল বরার যুগলবন্দিতে অসমে আগামী দিনে কৃষিক্ষেত্রে এক বিরল নজির স্থাপন করবে। রাজ্যের মোট ৩০.১৫ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমিতে সঠিক উপায়ে ফসল উৎপাদন হলে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অসম সমগ্র দেশের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে এক অন্যতম রফতানিকারি রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। রাজ্য সরকার সে দিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করে চলছে। মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা এবং কৃষিমন্ত্রী অতুল বরার নেতৃত্বে রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বিরোধীদের আনিত কৃষি বিভাগের কর্তন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এবং সরকার কর্তৃক কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দের সমর্থনে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে আজ মঙ্গলবার বিধানসভায় কথাগুলো তুলে ধরেন পাথারকান্দির বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু পাল।
গত বছরের ভিয়েতনাম সফরের উপলব্ধি বিধানসভায় তুলে ধরে কৃষ্ণেন্দু বলেন, বিশ্বের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ দেশ হয়েও, কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের এক বিরল নজির বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। সে দেশের সিংহভাগ জিডিপি কৃষির উপর নির্ভরশীল। ভারত থেকে ধানের বীজ নিয়ে ইন্ডিকা নামে ফসল উৎপাদন করছেন সে দেশের কৃষকরা। এবং সেই উৎপাদিত ইন্ডিকা চাল আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রফতানি করে বিপুল অর্থ রোজগার করছেন ভিয়েতনাম সরকার ও সে দেশের কৃষকরা। অনুরূপভাবে জাপান থেকে ধানের বীজ এনে জাপানিকা নামে ধানের ফসল উৎপাদন করে, পুনরায় জাপানেই চাল রফতানি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন ওই দেশের সরকার ও কৃষককুল।
তিনি বলেন, অসমে ৩০ লক্ষাধিক হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রাজ্য কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারার জন্য পূর্বতন অ-বিজেপি সরকারগুলোকেই কাঠগড়ায় তুলেন বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু। বলেন, একটি দেশ ও একটি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিক্ষেত্রে যত উন্নতি ঘটবে, দেশ বা রাজ্য ততই আর্থিকভাবে শক্তিশালী বা সমৃদ্ধশালী হবে। কিন্তু রাজ্যের পূর্বতন অবিজেপি সরকারগুলো সেদিকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি বলে অভিযোগ তুলেন কৃষ্ণেন্দু পাল।
২০১৬ সালে রাজ্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই, কৃষিক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় কার্যকালে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে রাজ্যকে সমগ্র দেশের মধ্যে একটি অন্যতম আত্মনির্ভরশীল রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। আর সেইদিকে লক্ষ্য রেখেই মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং কৃষিমন্ত্রী অতুল বরা এবারের বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করেছেন। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং কৃষিমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন কৃষ্ণেন্দু।
বিধায়কের গৃহজেলা করিমগঞ্জে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে কৃষ্ণেন্দু পাল বলেন, ১ লক্ষ ২১ হাজার ৪৫৩ হেক্টর কৃষিজমি রয়েছে করিমগঞ্জ জেলায়। এর মধ্যে দ্বিফসলি জমি রয়েছে ২৯ হাজার ৩৯০ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমি রয়েছে ৪ হাজার ৩৮৪ হেক্টর। কিন্তু জেলার মোট কৃষি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বলে বিধানসভায় আক্ষেপ করেন কৃষ্ণেন্দু। জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল। করিমগঞ্জ জেলায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই করিমগঞ্জ জেলার কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য অধিক গুরুত্ব দিতে কৃষিমন্ত্রী অতুল বরার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিধায়ক পাল। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র পাথারকান্দিতেও কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বিধানসভায় তুলে ধরেন তিনি।
বলেন পাথারকান্দির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। সেই সঙ্গে রয়েছে ১৮টি বড় চা-বাগান। আর এই চা-বাগানের প্রায় ৩০ শতাংশ লোক কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের নিজস্ব জমি না থাকার ফলে তাঁরা বাগানের জমিতেই ধান, সবজি সহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে থাকেন। যেহেতু তাঁদের নিজস্ব জমি নেই, তাই তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সাহায্য থেকে বঞ্চিত। প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি এবং মুখ্যমন্ত্রী কৃষক নিধির কোনও সুবিধা নিতে পারছেন না। চা-বাগানের এই সকল কৃষকদের কীভাবে পিএম কৃষক সম্মান নিধি এবং মুখ্যমন্ত্রী কৃষক নিধির আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে মুখ্যমন্ত্রী এবং কৃষিমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানান কৃষ্ণেন্দু।
কৃষিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, জেলায় সবজির চাহিদা মেটাতে পাথারকান্দি বিধানসভার অন্তর্গত দোহালিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি বানরের উপদ্রবে দোহালিয়ার কৃষককুল নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। বানরের পাল সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে চলছে। বানরের উপদ্রবে দোহালিয়ায় সবজি ক্ষেত করতে পারছেন না কৃষকরা। এতে একদিকে কৃষকদের আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, অন্যদিকে জেলায় সবজির আকাল দেখা দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় কম ফলনের কারণে সাধারণ জনগণকে বেশি দামে সবজি ক্রয় করতে হচ্ছে। যেহেতু বানর লেবু গাছ নষ্ট করে না, তাই দোহালিয়ার কৃষকদের কথা চিন্তা করে সবজি ক্ষেতের চারদিকে লেবু চাষ করার ব্যবস্থা নিতে কৃষিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কৃষ্ণেন্দু।
সেই সঙ্গে জেলায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য পাথারকান্দিতে প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব শীঘ্র বাস্তবায়িত করতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। প্রসঙ্গক্রমে কৃষ্ণেন্দু বিধানসভায় তাঁর বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, দোহালিয়া পার্শ্ববর্তী তথা দক্ষিণ করিমগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের বাজারঘাটে একটি অ্যাগ্রিকালচারাল ফার্ম হাউস রয়েছে। কিন্তু পূর্বতন অবিজেপি সরকারের উদাসীনতার কারণে এই ফার্ম হাউসটি বেদখল হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এই ফার্ম হাউসের জমির উপর একটি বাংলা ইটভাটা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় কৃষকদের স্বার্থে বেদখলে চলে যাওয়া এই অ্যাগ্রিকালচারাল ফার্ম হাউসটি জবরদখল-মুক্ত করতে কৃষিমন্ত্রী অতুল বরার কাছে দাবি জানান কৃষ্ণেন্দু।
পাথারকান্দি সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভাগীয় কোয়ার্টারগুলোও বেদখল হয়ে গিয়েছে। মূল্যবান সরকারি জমি বেদখল-মুক্ত করতেও বিধানসভায় জোরালো দাবি জানান কৃষ্ণেন্দু। জেলার বেশ কয়েকটি চা-বাগান বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চা-বাগান শ্রমিকদের দুর্দশা চরমে উঠেছে। বন্ধ হয়ে পড়া চা-বাগানগুলোতে রবিশস্য সহ বিভিন্ন কৃষিজাত শস্য চাষের ব্যবস্থা নিতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু। সেইদিকে লক্ষ্য রেখে বাজেটে এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করার দাবি জানান তিনি।

