আগরতলা, ১ ডিসেম্বর (হি.স.) : মৈত্রী সেতু। ফেণী নদীর উপর নির্মিত ব্রিজ ত্রিপুরায় ভারত ও বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। ওই সেতুকে ঘিরে নয়া অধ্যায় রচনা হয়েছে ত্রিপুরায়। তৈরি হয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। সবই ত্রিপুরার ভৌগলিকগত অবস্থানের জন্যই সম্ভব হয়েছে। ১.৯ কিমি দীর্ঘ ওই সেতু আগামীদিনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গেটওয়ে হতে চলেছে। কারণ, পণ্য পরিবহণে সবচেয়ে সাশ্রয়কর মাধ্যমে পরিণত হবে মৈত্রী সেতু, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে খুবই অল্প সময়ে এবং কম পরিবহণ খরচে পণ্য আমদানি সম্ভব হবে। স্বাভাবিকভাবেই ত্রিপুরা এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল এতে উপকৃত হবে, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন করেছিলেন। তবে এখনও পণ্য আমদানি-রফতানি শুরু হয়নি। কারণ, ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট তৈরি হতে ২০২২ সালের নভেম্বরের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাত্রী পরিবহণে ত্রিপুরা পরিকাঠামোগত দিক দিয়ে প্রস্তুত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত মিললেই মৈত্রী সেতু দিয়ে যাতায়াত শুরু হয়ে যাবে, এমনটাই দাবি করেছেন ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের অধিকর্তা তরিৎকান্তি চাকমা।
অতীতের দিকে ফিরে তাকালে স্পষ্ট নজরে আসছে, ভৌগলিকগত অবস্থান ত্রিপুরাকে দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। একটি মাত্র জাতীয় সড়ক বর্ষাকালে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ত। ফলে, ত্রিপুরাবাসীর দুর্দশার অন্ত ছিল না। বহিঃরাজ্যে যাওয়ার জন্য ভরসার মাধ্যম ছিল আকাশপথ। সময়ের সাথে পরিবর্তন হতে শুরু করল ত্রিপুরার পরিস্থিতি। উগ্রপন্থী সমস্যা কাটিয়ে ত্রিপুরা পুরোদস্তুর স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু যোগাযোগের দিক দিয়ে উন্নতি অথৈ জলে ছিল।
২০০৮ সালে ত্রিপুরায় প্রথম মিটার গেজে রেলের সাইরেন বাজতেই মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আগরতলা স্টেশনে রেলের ইঞ্জিন পৌঁছতেই হাজারো মানুষের ভিড় স্বাধীনতার স্পর্শের অনুভূতি বোঝাতে চাইল। সে থেকে শুরু, ত্রিপুরাও যোগাযোগে উন্নত হওয়ার দিকে পা বাড়িয়ে দিল। সময় যত গড়ালো ততই ত্রিপুরায় যোগাযোগের নতুন নতুন অধ্যায় রচিত হতে লাগল। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তনের পর ত্রিপুরাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৬ সালে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে ব্রডগেজে ত্রিপুরা যুক্ত হল।
এর পরই সম্প্রসারিত হল জাতীয় সড়ক। সাথে খুলে গেল বিকল্প জাতীয় সড়ক। ফলে, এক সময়ের ভৌগলিকগত অবস্থানের অভিশাপ থেকে ত্রিপুরা ক্রমশ মুক্তির পথে এগিয়ে চলছিল। এদিকে বাংলাদেশের নদীবন্দর ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজার দখলে পরিকল্পনা নিল ভারত সরকার। তাতেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা নতুন যুগে প্রবেশের দ্বার খুলে গেল। আগরতলা-আখাউড়া রেল লিংক, সাথে মৈত্রী সেতু দেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে ত্রিপুরাকে যুক্ত করার রূপরেখা তৈরি হয়ে গেল। আগরতলা-আখাউড়া রেল লিংক স্থাপনে কাজ কিছুটা বাকি। কিন্তু ২০১৫ সালে নির্মাণকাজের যাত্রা শুরু হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে নির্মিত হল মৈত্রী সেতু।
ওই মৈত্রী সেতুকে কেন্দ্র করে সাব্রুমে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে ত্রিপুরা সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে সাব্রুমে ১৬ হেক্টর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। সাব্রুমের বিধায়ক শংকর রায় বলেন, মৈত্রী সেতু ত্রিপুরার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে করি। কারণ, মৈত্রী সেতুকে ঘিরে ইতিমধ্যেই প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তাঁর কথায়, ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট নির্মাণে ৫০ একর জমি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বাস টার্মিনালের জন্য ১০ একর এবং ট্রাক টার্মিনালের জন্য ১৪ একর জমি ইতিমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। ১ একর জমিতে মাল্টি চেম্বার কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করা হবে। ৫০ একর জমিতে শূকরের ফার্ম এবং মাংস বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সাথে তিনি যোগ করেন, রেলে পণ্য উঠা-নামা করার জন্যও জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। সাথে পর্যটনের জন্য ২২ একর জমি দেওয়া হয়েছে।
বিধায়ক শংকর রায়ের দাবি, মৈত্রী সেতু দিয়ে পণ্য পরিবহণে ২০২২ সালের ডিসেম্বর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। কারণ, ২০২২ সালের নভেম্বরের মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ত্রিপুরা এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনেক কম সময়ে পণ্য পরিবহণে চার লেন জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা হবে। এতে সময় এবং অর্থ উভয়ই সাশ্রয় হবে।
ত্রিপুরা মার্চেন্ট অ্যাসোশিয়েশনের সম্পাদক সুজিত রায় বলেন, ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে মৈত্রী সেতু দিয়ে পণ্য আমদানির অপেক্ষায় বসে রয়েছেন। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহণে অন্তত ২০ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। এতে পণ্যের দাম অনেক কমবে, উপকৃত হবেন ক্রেতারাও। সাথে তিনি যোগ করেন, মৈত্রী সেতু চালু হলে দক্ষিণ-এশিয়া থেকে পণ্য আমদানি অনেক সহজ হবে এবং আর্থিক দিক দিয়ে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তাঁর দাবি, শুধু ত্রিপুরা নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল এই সুযোগ নিতে পারবে। এতে আর্থিক দিক দিয়ে অন্যান্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি-রফতানি ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৩৯০ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি হয়েছে। সে তুলনায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৭৩৩.২৬ কোটি টাকা। এ-বিষয়ে ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের অধিকর্তা তরিৎকান্তি চাকমা বলেন, আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টে ১২ একর জমিতে চলতি অর্থ বছরের ৭০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। সে তুলনায় সাব্রুমে ৫০ একর জমিতে গড়ে ওঠা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট বাণিজ্যের পরিমাণ অনেকটাই বেশি হবে, সহজেই তা অনুমান করা যাচ্ছে।
এদিন তিনি দাবি করেন, মৈত্রী সেতু দিয়ে যাত্ৰী পরিবহণে ত্রিপুরা প্রস্তুত রয়েছে। সে মোতাবেক পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অংশে পরিকাঠামোগত কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। তাই বাংলাদেশের তরফে সবুজ সংকেত মিললেই মৈত্রী সেতু দিয়ে যাত্রী পরিবহণ শুরু হয়ে যাবে।