সমীপকুমার দাস
গুয়াহাটি, ২৪ মার্চ (হি.স.) : রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বরিষ্ঠ প্রচারক গৌরীশংকর চক্রবর্তীর দেহাবসান ঘটেছে। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। তবে দুরারোগ্য ব্যাধিকে পরাস্ত করে তিনি সংঘের দায়িত্ব আমৃত্যু নিষ্ঠা সহকারে পালন করে গেছেন। গত বছরের আগস্টে ডিব্রুগড় গিয়ে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে কোভিডকেও জয় করে ফের সংঘ তথা সমাজের কাজ করে গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। আজ বুধবার সকাল ৬:০০ মিনিটে দিল্লির ৪-সি ইনস্টিটিউশনাল এরিয়া, নর্থ এক্সটেনশনে অবস্থিত এমডি সিটি হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বরিষ্ঠ প্রচারক চক্রবর্তী।
এদিকে সকলের প্রিয় গৌরীদার আকস্মিক প্রয়াণে সংঘের সর্বস্তরের পদাধিকারী, কার্যকর্তা, স্বয়ংসেবক এবং তাঁর পরিচিত মহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ব্যক্ত করে প্রয়াতের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল, বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দিলীপ শইকিয়া, প্রদেশ সভাপতি রঞ্জিতকুমার দাস, মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা প্রমুখ বহুজন। গৌরীদার নশ্বর দেহ আগামীকাল তাঁর গৃহজেলা কাছাড়ের সদর শহর শিলচর নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে তাঁর পৈত্রিক আবাস জালালপুরে নিয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন পাঁচ ভাই, ভ্রাতৃবধূ, ভ্রাতুষ্পুত্র-পুত্রী, নাতি-নাতিনি সহ সংঘের অসংখ্য গুণমুগ্ধকে।
জালালপুরের অতি জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. খগেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী এবং সুষমাদেবীর (প্রয়াত) সাত সন্তানের চতুর্থ ছিলেন গৌরীশংকর। জন্ম হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর (বাংলা ১৩৫৬ সনের ১১ অগ্রহায়ণ) রবিবার অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার ছাতক থানার মহবৎপুরে। তাঁর বড়ভাই শিবশংকর চক্রবর্তীও ছিলেন একজন প্রচারক এবং অবশ্যই খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক। এমবিবিএস শিবশংকর চক্রবর্তী তদানীন্তন উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা অধুনা ডিমা হাসাও জেলা সদর হাফলঙে বিশ্বহিন্দু পরিষদের দায়িত্বে থেকে উপজাতিদের মধ্যে আজীবন চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে গেছেন। তিনি গত প্রায় তিন দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন।
অত্যন্ত মেধাবী ও বোদ্ধা গৌরীশংকর চক্রবর্তী শৈশব থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। নিয়মিত শাখায় যাতায়াত তাঁর বিদ্যালয় জীবন থেকে। ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি গোটা রাজ্যের মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান দখল করেন। পরবর্তীতে গুয়াহাটি এসে কটন কলেজে পদার্থবিজ্ঞান শাখায় ভরতি হয়ে প্রথম বিভাগে খ্যাতির সঙ্গে স্নাতক-উত্তীর্ণ হন। পরে চলে যান দিল্লি। দিল্লি গিয়ে কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে খ্যাতির সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত হন গৌরীশংকর। পঠন-পাঠনে অত্যন্ত একাগ্রতা থাকায় এর পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও দুরারোগ্য এই ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। তার পর ২০১৮ সালে মেরুদণ্ডের নানা উপসর্গ দেখা দেয়। দিল্লির হাসপাতালে মেরুদণ্ডে অপারেশন করে সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে শারীরিক কিছু অসুস্থতার জন্য তাঁকে দিল্লির এমডি সিটি হাসপাতালে নিয়ে ভরতি করা হয়। কিন্তু ডাক্তারদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে আজ সকালে ইহধামের মায়া কাটিয়ে বৈকুণ্ঠধামে চলে যান সকলের প্রিয় গৌরীদা।
সংঘের টানে দিল্লিতে অবস্থানকালে ১৯৭৩ সালে প্রচারক হয়ে বেরিয়ে পড়েন গৌরীশংকর চক্রবর্তী। সে থেকে তাঁর প্রচারকজীবন শুরু। দিল্লিতে পাঁচ বছর প্রচারকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। পরবর্তীতে জরুরি অবস্থার পর ১৯৭৮ সালে তাঁকে পাঠানো হয় গুয়াহাটি মহানগর প্রচারকের দায়িত্ব দিয়ে। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত একই দায়িত্ব পালনের পর ওই সালেই তাঁকে পাঠানো হয় ডিব্রুগড়ে, বিভাগ প্রচারক হিসেবে। ১৯৮৩ থেকে ১০৯১ সাল পর্যন্ত ডিব্রুগড়ে ছিলেন। ১৯৯১ সালে শিলচর সম্ভাগ প্রচারক করে তাঁকে পাঠানো হয়। ১৯৯৪ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয় দক্ষিণ অসম প্রান্ত প্রচারকের। ওই দায়িত্বে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন।
পরবর্তীতে ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ক্ষেত্র শারীরিক প্রমুখ হিসেবে। এর পর ২০১২ সালে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সহ-ক্ষেত্র (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) প্রচারকের। প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও দৃঢচেতা গৌরীশংকর তাঁর দায়িত্ব পালনে কোনওদিন কিঞ্চিৎমাত্র অবহেলা করেননি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁকে সহ-ক্ষেত্র প্রচারকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সংঘের অখিল ভারতীয় কার্যকারিণী মণ্ডলের আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়। মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দায়িত্বও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন।
প্রয়াত গৌরীশংকর চক্রবর্তী একজন সুগায়কও ছিলেন। এই গুণ তাঁর পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ছিল। তাঁর মা বাবা, সাতভাইই ভালো গায়ক, মোদ্দা কথায় গোটা পরিবারই সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া বেশ কয়েকটি গানে সুর দিয়ে সুরকারের খ্যাতিও অর্জন লাভ করেন গৌরীশংকর।
কেবল তা-ই নয়, রাষ্ট্রবাদ সম্পর্কিত ইংরেজি ও অসমিয়া ভাষায় বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এছাড়া ইংরেজি, হিন্দিতে লেখা পঞ্চাশোর্ধ্ব গ্রন্থ তিনি অসমিয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ২০১৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করে যখন ক্যামো দেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রায় তিনমাসের মধ্যে দত্তপন্থ ঠেংড়ির লেখা ‘কার্যকর্তা’ শীর্ষক এক বড় বই অনুবাদ করেছেন। শেষবারের মতো হাসপাতালে যাওয়ায় দিন-কয়েক আগে ‘আধুনিক ভারতর খনিকর ডা. হেডগেওয়ার’ শীর্ষক সংকলনগ্রন্থ অনুবাদ এবং বিভিন্ন গ্রন্থের প্রুফ দেখে প্রচণ্ড মনোবল ও ইচ্ছাশক্তির দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন প্রয়াত গৌরীশংকর চক্রবর্তী। কয়েকদিন আগে ‘আধুনিক ভারতর খনিকর ডা. হেডগেওয়ার’ শীর্ষক সংকলনগ্রন্থটি ছাপা হয়ে কেশবধামে এসেছে। মৃত্যুর একদিন আগে সোমবার দুপুরের দিকেও নাকি হাসপাতালের শয্যা থেকে বইয়ের কতটা কপি কোথায় যাবে সে সব ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গৌরীশংকর চক্রবর্তী একজন ভালো বংশী, বিউগল ও আনক (ড্রাম) বাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন উঁচুমানের দণ্ডযোদ্ধাও। সংঘের নানা শিবিরে তাঁকে স্বয়ংসেবকদের দণ্ড শিক্ষার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হত।
2021-03-24