রতন লাল কাটারিয়া
এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে সংসদে ২০২১-এর বাজেট উপস্থাপিত করা হয়। নতুন জীবানুটি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এক মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা, অর্থনীতি, প্রশাসন সামাজিক কাঠামো এবং সর্বোপরি একটি দেশ হিসেবে এ ধরনের সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আমাদের সক্ষমতা কতটা সহনশীল তাও পরীক্ষা করে দেখেছে।
এটা প্রায়শই বলা হয় যে “সংকটজনক পরিস্থিতি হল এক হয় এগিয়ে যাওয়া অথবা যেখানে তুমি রয়েছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকার একটি সুযোগ”। এখানে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকদর্শনের প্রশংসা করতে চাই, যিনি ‘কোভিড উত্তর বিশ্ব ব্যবস্থা’-য় দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন এবং তত্ক্ষনাৎ আত্মনির্ভর ভারতের লক্ষ্যে ভারতের ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে একটি পথ নির্দেশিকাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ২০২১-এর বাজেট এই দিকদর্শনেরই একটি অভিব্যক্তি।
অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার ফলে অর্থনীতিকে ‘ভি’ আকৃতির আধারে উদ্বার করে টেনে তোলা এবং ‘জনগণের জীবনযাত্রা’-কে সুরক্ষিত করার মতো জোড়া সমস্যা তো ছিলই সেজন্য জনকল্যাণ, সম্প্রসারিত আর্থিক ঘাটতি মেটাতে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হয়েছে। তবে যেভাবেই হোক, অর্থমন্ত্রী এমন এক দীপ্তিমান বাজেট নিয়ে এসেছেন যা ‘আমাদের অর্থনীতির জন্য টিকা’ হিসেবে প্রমাণিত হবেই।
সরকার ২০২১-এর বাজেটের মাধ্যমে কৃষকদের মন থেকে ভয় প্রসমিত করেছেন। কৃষির পরিকাঠামো ও উন্নয়ন কর চালু করা, কৃষি ঋণের পরিমাণ ১৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, এবং এপিএমসি সমূহের পরিকাঠামো বৃদ্ধি করার জন্য পরিকাঠামো তহবিল বরাদ্দ করার মাধ্যমে সরকারের কৃষক কল্যাণকামী সদিচ্ছা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এমএসপি’র জন্য কেন্দ্রে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমস্ত সামগ্রীর ক্ষেত্রে উত্পাদন ব্যয়ের ১.৫ গুণ করা হয়েছে এবং এটা প্রধানমন্ত্রী যে সংসদে বলেছিলেন ‘এমএসপি ছিল, এমএসপি আছে এবং এমএসপি থাকবে’ সেই কথাকে পুনরায় সুনিশ্চিত করেছে।
সরকার পরিকাঠামো উন্নয়নে খুবই জোর দিয়েছে এবং বিকাশ ও কর্মসংস্থানকে বেগবান করতে পরিকাঠামো খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করার ফলে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ২০২১-২২-এর বাজেটে মূলধনী ব্যয় বাবদ তাত্পর্যপূর্ণভাবেই বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে করা হয়েছে ৫.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০২০-২১-এর বাজেটের চেয়ে ৩৪.৫% বেশি। ২০,০০০ কোটি টাকার বরাদ্দ সহ ডেভেলপমেন্ট ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন স্থাপন, ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন সম্প্রসারণ এবং ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন সৃষ্টি আসন্ন প্রকল্প সমূহের সম্পদ বৃদ্ধিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। মূলধনী ব্যয় বাবদ ১,০৮,০০০ কোটি টাকা সহ মোট ১,১৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রকের জন্য যা সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ। বিগত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব বিকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে এই ক্ষেত্রে এবং প্রায় ২,২৪,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ সহ তামিলনাড়ু, কেরালা ও আসামে ৩-টি নতুন অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বারের ঘোষণার মাধ্যমে এই বিকাশ আরো গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এটা খুবই উত্সাহব্যঞ্জক কথা যে সরকার জাতীয় রেল পরিকল্পনা ২০৩০ প্রস্তুত করেছে যা অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রেল ব্যবস্থার “ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও, ২০২২-এর মধ্যে পশ্চিম ও পূর্বের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ফ্রেইট করিডোরের কাজ সম্পূর্ণ করতে সরকার নতুন আরো কয়েকটি ফ্রেইট করিডোর নির্মাণ করার জন্য প্রস্তাব করেছে। এটা অবাধ ফ্রেইট পরিবহনকে সক্ষম করে তুলবে এবং আমাদের শিল্প ব্যবস্থার পরিবহন ব্যয়কে অনেক গুণ হ্রাস করবে।
ভারতে শহরাঞ্চলের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই ক্রমবর্দ্ধমান নগর কেন্দ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আমাদের বর্তমান নগর পরিকাঠামো উন্নয়ন, নতুন সুযোগ সুবিধার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন। বাজেট ২০২১-এ সরকার ১৮,০০০ কোটি টাকার বরাদ্ধ সহ পিপিপি পদ্ধতিতে সরকারি বাস পরিবহন পরিষেবা বৃদ্ধি করতে নতুন একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছে। এছাড়াও টায়ার-টু মহানগর এবং টায়ার-ওয়ান মহানগর সমূহের এলাকাগুলিতে মেট্রো রেল এবং আরআরটিএস নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী করতে প্রস্তাব রাকা হয়েছে।
জল জীবন মিশন (আরবান) পরবর্তী পাঁচ বছরে শহরাঞ্চলের ৪,৩৭৮-টি স্থানীয় প্রশাসন যাতে পাইপলাইনে জল সরবরাহ করতে পারে সেজন্য ২.৮৭ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ সহ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণাটি করা হয়েছে জেজেএম (রুরাল)-এর গৌরবময় সাফল্যের উপর ভর করে, যার মাধ্যমে স্বাধীনতার পর মাত্র এক বছরের ২০১৯ পর্যন্ত ৩.২৩ কোটি গ্রামীণ পরিবারে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমি আমার এর আগের লেখাগুলিতে জেজেএম প্রকল্পটিকে একটি সামাজিক বিপ্লব হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম, এই প্রকল্পটির ফলাফপল শুধুমাত্র জনগণকে জল সরবরাহ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা পাইপ ফিটার, প্লাম্বার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, পাম্প ওপারেটর ইত্যাদির মতো নানা ধরণের দক্ষ কর্মীর চাহিদা সৃষ্টি করেছে। এটা গ্রামাঞ্চলে মহিলাদের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত জল সরবারহ প্রকল্প বাস্তবায়নে পানিসমিতি-গুলিতে তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বরাদ্দের ১৩৭% বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। নতুন একটি প্রকল্প- প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভরস্বাস্থ্য ভারত যোজনা ঘোষিত হয়েছে যার জন্য পরবর্তী ৬ বছরের মেয়াদে ৬৪,১৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকার মিশন পোষাণ ২.০ এবং আরবান স্বচ্ছ ভারত মিশন ২.০ ঘোষণা করেছে যা স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর তাত্পর্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলবে।
১০০-টি নতুন সৈনিক বিদ্যালয়, উপজাতি প্রধান এলাকাগুলিতে ৭৫০-টি নতুন একলব্য আদর্শ আবাসিক দিব্যালয় স্থাপন এবং নতুন শিক্ষা নীতি অনুযায়ী বর্তমান ১৫,০০০ বিদ্যালয়ের গুণমান উন্নয়ন তরুণ প্রজন্মের জন্য গুণমানযুক্ত শিক্ষা প্রদানকে উন্নত করবে। পরবর্তী ৫ বছর ধরে তপশিলি জাতি সমূহের জন্য মাধ্যমিক উত্তর মেধাবৃত্তি প্রকল্প-কে নতুন করে পুনর্গঠনের প্রয়াসে যে ৩৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হয়েছে তা একটি আনন্দদায়ক পদক্ষেপ। এটা ৪ কোটিরও বেশি তপশিলি জাতি ভুক্ত শিক্ষার্থীকে উপকৃত করবে এবং বিদ্যালয়-ছুট বা ড্রপআউটকে রোধ করার মাধ্যমে গড় ভর্তি প্রকিয়ার অনুপাতকে (উচ্চ শিক্ষায়) উন্নত করতে সহায়তা করবে। এই সঙ্গে তপশিলি জাতি সমূহের জন্য কল্যাণমুলক প্রকল্পগুলিতে বিভিন্ন মন্ত্রকের মাধ্য সার্বিক বরাদ্দের পরিমাণ ৮৩,২৫৬ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১,২৬,২৫৯ কোটি টাকা যা প্রায় ৫১%-র মতো বেড়েছে। এছাড়াও আমাদের প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে যাদের আয়ের উত্স শুধুই পেনশন ও সুদ তাদের কর দাখিল করা থেকে রেহাই দেওয়ার মাধ্যমে বিশেষ যত্ন গ্রহণ করা হয়েছে। তাই এই বাজেট মোদী সরকারের কর্মসূচি “সবকা সাথ সবকা বিকাশ”-এর প্রতীক।
সব মিলিয়ে এই বাজেট সাদরে গৃহীত হয়েছে এবং বাজারও এর প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী আর্থিক বিচক্ষণতার বজ্রআটুনির উপর দিয়ে হেঁটেছেন এবং জনকল্যাণ ও জনঘণের জীবনযাত্রাকে সুরক্ষিত করতে এমন এক বাজেট উপস্থাপনা করেছেন যাতে অর্থনৈতিক বিকাশকে গতি দিতে মূলধনী ব্যয় ও সরকারি খরচের মধ্যে একটি সুচারু ভারসাম্য রাখা হয়েছে। এটাই ছিল সময়ের চাহিদা এবং আগামী দিনগুলিতে আত্মনির্ভর ভারতের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে। আর এ জন্যেই আমি এই বাজেটকে এমন এক বাজেট বলে অবহিত করছি- যা দেশের স্পন্দনকে আয়ত্তে আনে।