দিন আসে দিন যায়, থেকে যায় শুধু স্মৃতি। বছরের শুরুটাই খারাপভাবে শুরু হয়েছিল। শেষটাও ভালো কাটল না। ২০২০ বছরটাই কেটেছে করোনাভাইরাসের প্রকোপে। কোভিড-১৯ ছাড়াও বহু কারণে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে সাল ২০২০। এ বছরই ভারত সফরে এসেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সপরিবারের ট্রাম্প যখন দিল্লিতে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজধানী দিল্লি। দিল্লি হিংসায় মৃত্যু হয়েছিল বহু নিরপরাধ মানুষের, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছিল।
তবে, ভালো কিছু হয়েছে এ বছরে। করোনাকে ছাপিয়ে শিরোনামে উঠে এসেছিল রামমন্দিরের ভূমিপুজো। ভুমিপুজো ও শিল্যানাস হয়েছে নতুন সংসদ ভবনের। আবার পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চিনের সেনার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেশজুড়ে চিনের প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। চিনা পণ্য বয়কটের দাবি ওঠে ভারতে। ভারত সরকারও বহু চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছিল। করোনা-পরিস্থিতিতেই ভারতকে আত্মনির্ভর করে তোলার অঙ্গীকার নিয়েছেন দেশবাসী।
এ বছরই উত্তর প্রদেশের হাথরাসের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। প্রতিবাদে সরব হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। করোনা-আবহেই দেশে প্রথম বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। এবছরই জম্মু ও কাশ্মীরে জেলা উন্নয়ন পর্ষদের নির্বাচন হয়েছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হওয়ার পর এটাই জম্মু ও কাশ্মীরে প্রথম ভোট। কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষি আইনের প্রতিবাদে কৃষকদের আন্দোলনও দেশবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছে এ বছরই। আবার করোনাকালে লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে আসা সবথেকে বেশি ব্যাকুল করে তুলেছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে।
দেখে নেওয়া যাক বছরভর কী কী ঘটনা সংবাদের শিরোনামে ছিল ২০২০ সালে:
জানুয়ারি :
জানুয়ারি মাসের শুরুতেই ৫ জানুয়ারি ভরসন্ধ্যায় মুখোশ পরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায় এক দল দুষ্কৃতী। এই ঘটনা আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি
১০-শাহিনবাগের আন্দোলকারীদের উৎখাতের আবেদন খারিজ করলেও, রাস্তা বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না বলে কেন্দ্রকে জানায় সুপ্রিম কোর্ট। এ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রকে এই নোটিস পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট।
১৭— সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলাদের সমানাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে এবছরই।
২৩— নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল উত্তর-পূর্ব দিল্লি। দিল্লি হিংসায় বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
২৪— সপরিবারের দু’দিনের ভারত সফরে আসেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রথমে গুজরাটে যান ট্রাম্প, সেখান থেকে দিল্লিতে।
মার্চ
১২- কর্নাটকে ৭৬ বছরের এক ব্যক্তি ভারতে প্রথম করোনায় মারা যান। এরপরই দেশজুড়ে শুরু হয় করোনা-আতঙ্ক!
২৩- প্রথম পর্যায়ের লকডাউন শুরু। জাতির উদ্দেশে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। যে যেখানেই আসছেন, তাঁকে সেখানে থাকতে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী। বন্ধ হয়ে যায় রেল, বিমান পরিষেবা।
এপ্রিল
১৫- দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউন শুরু, ৩ মে পর্যন্ত।
৩০- প্রয়াত হন অভিনেতা ঋষি কাপুর (৬৮)। ৩০ এপ্রিল মুম্বইয়ের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ অভিনেতা ঋষি কাপুর। ঋষি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন।
মে
৩- তৃতীয় পর্যায়ের লকডাউন শুরু।
১৪- ১৪ জুন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাটে। এই মৃত্যুর খবর নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। মুম্বই পুলিশ আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও তাঁর পরিবারের তরফে খুনের অভিযোগ আনা হয়। শুরু হয় ‘জাস্টিস ফর সুশান্ত’ আন্দোলন। তদন্তে উঠে আসে বলিউডের মাদক যোগের প্রসঙ্গও। সুশান্তের মৃত্যুকে ঘিরে তোলপাড় পড়ে যায় বিনোদন জগতে।
১৮- চতুর্থ পর্যায়ের লকডাউন শুরু।
জুন
১- আনলক ১ পর্যায় শুরু।
১৫- চিন সীমান্তে সংঘর্ষে হত ১৫। মে মাস থেকেই অবনতি হয়েছিল পরিস্থিতির। এরপর ১৫ জুন পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনের আগ্রাসনের ফলে দেশের ১৫ জন জওয়ান শহিদ হন। ভারতের হিসেবে অন্তত ৪৩ জন লালফৌজের সদস্যেরও মৃত্যু হয়েছিল ওই সংঘর্ষে। কয়েক মাস পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বছর শেষেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। সীমান্তে বজায় রয়েছে উত্তেজনা।
জুলাই
১ আনলক ২ পর্যায় শুরু।
১০- উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টারে হত বিকাশ দুবে। উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে ‘ধরা’ পড়ে বিকাশ দুবে। সেখানকার মহাকাল মন্দির চত্বরের এক ফুলওয়ালা তাকে দেখে চিনতে পেরে নিরাপত্তারক্ষীদের খবর দেয়। ১০ জুন এনকাউন্টারে খতম হয় বিকাশ দুবে।
আগস্ট
১- আনলক ৩ পর্যায় শুরু।
৫- অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপুজো। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দিরই হবে। সেই ঐতিহাসিক রায় মেনে এবছর ৫ আগস্ট রামমন্দিরের ভূমিপুজো হয়। উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, সারা দেশজুড়েই এই পুজোকে ঘিরে আলোচনার পারদ চড়ে। মন্দিরের শিলান্যাস করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘সরযূ নদীর তীরে স্বর্ণযুগের সূচনা হল। অবসান হল দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষার।’’
৭- কোঝিকোড়ে নামার সময় পিছলে গিয়ে দু’টুকরো হয় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান, মৃত্যু হয় অন্তত ১৭ জনের, আহত হন বহু যাত্রী।
১৭— বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ পন্ডিত যশরাজ প্রয়াত হন (৯০)।
১৭— প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার ও উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী চেতন চৌহান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান (৭৩)।
৩১— ‘ভারতরত্ন’ এবং প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হন (৮৪)। মাথায় চোট পেয়ে দিল্লির সেনা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। পরে জানা যায় তিনি করোনা-আক্রান্ত। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ৩১ আগস্ট প্রয়াত হন প্রণব।
সেপ্টেম্বর
১১— প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং আর্য সমাজ-এর নেতা স্বামী অগ্নিবেশ (৮০)।
১৪— উত্তরপ্রদেশের হাথরসে ১৯ বছরের এক দলিত কিশোরীর গণধর্ষণ ও মৃত্যুর নির্মম ঘটনায় দেশব্যাপী ক্ষোভ তৈরি হয়। এ বছরই উত্তর প্রদেশের হাথরাসের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। প্রতিবাদে সরব হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
২৫— বিশিষ্ট গায়ক এসপি বালসুব্রহ্মনীয়ম মারা যান (৭৪)। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন।
২৭— মারা গেলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ (৮২)। ১৯৮০ থেকে ২০১৪– দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে সাংসদ ছিলেন তিনি।
২৭— সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় হাথরাসের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের উপরে নজরদারি চালাবে এলাহাবাদ হাইকোর্ট৷
সেপ্টেম্বর মাসেই সংসদে পাশ হওয়া তিনটি কৃষি বিলে সিলমোহর দেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এর ফলে বিলগুলি আইনে পরিণত হয়। এর জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়। কৃষি বিলের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন হরসীমরত কৌর বাদল। কৃষি বিল যেদিন রাজ্যসভায় পাশ হয়েছিল, সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজ্যসভা।
অক্টোবর
৩— হাথরস গণধর্ষণ মামলার সম্পূর্ণ তদন্তের ভার সিবিআই-কে।
৮— কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান মারা যান (৭৪)। বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। দিল্লির একটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। ৭৪ বছর বয়সে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।
১৬— ভারতের প্রথম অস্কারজয়ী (কস্টিউম ডিজাইনে) ভানু আথাইয়া মারা যান (৯১)।
২৯— গুজরাতের প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশুভাই প্যাটেল মারা যান (৯২)।
নভেম্বর
৩— বেহালাবাদক টিএন কৃষ্ণান প্রয়াত হন (৯২)। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ-সহ বিভিন্ন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
১১— বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ-র উল্লেখযোগ্য জয়। করোনা আবহে বিহারেই প্রথম বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। দারুণ ফল করেছে এনডিএ। পুনরায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নীতীশ কুমার।
২৫— দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলন শুরু। গত সেপ্টেম্বরে সংসদে পাশ হয়ে যায় কেন্দ্রের নতুন তিন কৃষি বিল। তা পরিণত হয় আইনে। আর তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ। একে কৃষক-বিরোধী বিল বলে দাবি করে বিরোধীরা। আন্দোলনে নামেন পঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ সারা দেশের কৃষকরা। অবশেষে গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে দিল্লি সীমান্তে জড়ো হয়ে বিল প্রত্যাহারের দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। বছর শেষেও যা অব্যাহত।
ডিসেম্বর :
১০- ১০ ডিসেম্বর নতুন সংসদ ভবনের ভুমিপুজো ও শিল্যানাস করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ৫৬০ ফুট ব্যাসের বৃত্তাকার সংসদ ভবন থেকে যাবে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে। তার পাশেই নতুন ত্রিভুজাকৃতি সংসদ ভবন তৈরি হবে প্রায় ৬৪,৫০০ বর্গমিটার জায়গার উপরে। খরচ হবে ৯৭১ কোটি টাকা। নতুন ভবনে লোকসভায় ৮৮৮ জনের বসার ব্যবস্থা হবে। রাজ্যসভায় ৩৮৪ জন বসতে পারবেন।