-ডা: হর্ষ বর্দ্ধন
মানবজাতি ২০২০ সালের একটি ঘটনাই শুধু মনে করতে পারবে এবং তা অবশ্যই এক মারাত্মক ও অজানা রোগজীবানুর গল্প যা সারা বিশ্বকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে, প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং অকল্পনীয় ক্ষতিসাধন করেছে অর্থনীতির। মানুষকে উদ্ধার করতে কীভাবে বিজ্ঞান ধাবিত হয়েছে ঐতিহাস সেই কথাও মনে রাখবে এবং কীভাবেই বা গবেষনা ও বিকাশের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সহযোগিতা হয়ে উঠেছে আলোকপাতের বিষয় তাও মনে করবে বার বার।
২০২০ সাল হয়ে উঠেছে ‘বিজ্ঞানের বছর’ যখন অবসাদের মধ্য দিয়ে মানবতা শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ প্রদর্শিত হয়েছে যা কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে ঘনিয়ে এসেছিল। এটা একটা তথ্যভান্ডারে রেখে দেওয়ার মতো বিষয়, রোগটির প্রকোপ বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়েছে এবং একইভাবে একে প্রতিহত করতে গৃহীত হয়েছে গবেষণামূলক প্রয়াস। বিজ্ঞানীরা যাতে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ভাগ করে নিতে পারে সেজন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ধরনের সহযোগিতা গড়ে তোলা হয়েছে এবং নিরাপত্তার দিকটির সঙ্গে কোনো রকম আপোশ না করে চিকিত্সা, টীকাকরণ ও রোগনির্ণয় যাতে দ্রুততার সঙ্গে করা যায় সেজন্য রোগনির্ণয়ক পরীক্ষার কাজে গতি আনতে পরিকল্পনা রূপায়িত করা হয়েছে। এই সমস্ত কাজের জন্য সরকারি, ব্যবসায়িক ও জনহিতকর সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে বিভিন্ন সম্পদ ও সরঞ্জাম দিতে শুরু করেছে, এ জন্যেই আমি বলছি এই বছরটি স্রেফ বিজ্ঞানের কারনেই উল্লেখযোগ্য নয়, উপরন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতারও বছর।
প্রকৃত পক্ষে, বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীদের যে আত্মত্যাগ প্রশংসা লাভ করেছে, তা শুধুমাত্র একগুচ্ছ জীবনদায়ী ওষুধ উত্পাদনের জন্যই নয়, বরং তা যে অকল্পনীয় দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে সেজন্যও বটে। এই সুযোগটাকে আমি গ্রহণ করেছি, যে সমস্ত সংগঠন কোভিড-১৯-এর গবেষণায় সাড়া দিয়ে সহযোগিতা করেছে ও গর্বিত করেছে আমাদের তাদের প্রত্যেকের প্রশংসায় প্রকাশ করেছি উচ্ছ্বাস।
এই অতিমারির সব চেয়ে বড় সাফল্য দলগত কাজ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজ ব্যক্তিগত পুরস্কারের প্রশ্নটি সরিয়ে রেখে সঠিক ফলাফলটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। দেশ, মহাদেশ অথবা বিশ্ব নির্বিশেষে বিজ্ঞানীরা এবং বিভিন্ন সংগঠন একটি অর্থবহ লক্ষ্যের উপর প্রকৃত অর্থেই আলোকপাত করেছেন।
অতিমারি চলাকালে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, আমরা যে কোনো পদক্ষেপের মোকাবিলা করতে পারি, আমাদের রোগনির্ণয়ের গুণমান রক্ষা করতে পারি এবং গুণমানের গুরুত্বকে অবহেলা না করে পরিচর্যা, আস্থা অর্জন ও বিশ্বাসকে সঠিক গতিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
আমি সব সময়ই ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য পরিচর্যায় আমাদের সহযোগিতার ফলাফলকে সমানভাবে বন্টন করা দরকার। আমরা অবশ্যই এগুলিকে বিশ্বের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেব এবং এক সাম্যময় বিশ্ব গড়ে তুলব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যনিবাহী পরিষদের সভাধিপতি হিসেবে আমি এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ, তহবিল দানকারী সংস্থা, বিজ্ঞানী ও জনহিতৈষীদের কাছে বার বার করে বলে আসছি। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছে এবং আমি এটাকে ২০২০-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি।
অতিমারির প্রেক্ষাপটে, আরো একবার এটা জোরদার হয়ে উঠেছে যে বিজ্ঞানী সমাজ সামাজিক সমস্যাগুলি মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক ও অপ্রতিহত প্রয়াসের স্বাক্ষর রেখেছে। এটা বললে অতিকথন হবে না যে বিগত সাড়ে ছয় বছরে আমাদের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তি বিশারদ ও উদ্ভাবকদের সুচিহ্নিত প্রয়াসের ফলে আমাদের সরকার অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজের সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১৫ থেকে ‘ভারত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান উত্সব”(আইআইএসএফ) আয়োজনের প্রয়াস কার্যত এই সত্যকেই উদযাপনের বাস্তব রূপ।
আইআইএসএফ-এর লক্ষ্য হল ‘বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি ও গণিত” (এসটিইএম) কীভাবে আমাদের জীবন মান উন্নয়নে সমাধান প্রদান করে তা তুলে ধরা এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে জনগণকে বিজরিত করা বিজ্ঞান-ভারতী (ভিআইবিএইচএ)-এর সঙ্গে মিলিতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক, পৃথিবী বিজ্ঞান মন্ত্রক আইআইএসএফ শীর্ষক এই অপূর্ব মঞ্চ সৃষ্টি করেছে যা অনুসন্ধিত্সাকে উদ্দীপিত করতে এবং বিজ্ঞানের পঠন-পাঠনকে আরোও ফলপ্রসু করে তুলতে চায়।
এই উত্সবের লক্ষ্য হল বিশেষ করে শিক্ষার্থী সমাজের কাছে পৌছানো যাতে তাদের বৈজ্ঞানিক উদ্দীপনাকে প্রজ্জ্বলিত করা যায়। যা শুরু হয়েছিল ছোট একটি অনুষ্ঠান হিসেবে, এখন ওটাই হয়ে উঠেছে বহু প্রতিক্ষিত বৃহত্ আকারের বার্ষিক বিজ্ঞান সমাবেশ যাতে শিক্ষার্থী, বৈজ্ঞানিক, বিদ্বজ্জন, সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণ মানুষ বিজড়িত হয়।
আইআইএসএফ এমন এক মঞ্চ যা সমাজের সব অংশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত এবং এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকজন গ্রহণ করতে আসেন অভিজ্ঞতা এবং তারা উপভোগ করেন বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম, সাফল্য ও জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রের উদ্ভাবনা সমূহ।
আমি এটা দেখে আনন্দিত যে আইআইএসএফ-এর প্রতিটি সংস্করণ ক্রমেই বৃহদাকার লাভ করছে, আরও উত্তম মানের হচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যাক জনগণকে আকৃষ্ট করে চলেছে। এই কর্মসূচি এক গভীর আগ্রহে প্রতীক্ষিত বিজ্ঞানের উদযাপন হিসেবে অভ্যুদিত হয়েছে। আইআইএসএফ-এ বৈজ্ঞানিক অনুষ্ঠানমালা বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে নজির গড়েছে এবং মর্যাদাপূর্ণ গ্রিনিস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ড এর পৃষ্ঠায় প্রবেশ করেছে।
এ বছর আইআইএসএফ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পালন করা হচ্ছে, চলবে ২২ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) তার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (সিএসআইআর-এনআইএসটিএডিএস)-এর মাধ্যমে এই মেগা ভার্চুয়াল ইভেন্ট-এর আয়োজন করছে।
আইআইএসএফ ২০২০-র মূল ভাব হল “আত্মনির্ভর ভারত ও বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য বিজ্ঞান” (সায়েন্স ফর সেল্প রিলায়েন্ট ইন্ডিয়া অ্যান্ড গ্লোবাল অয়েলফেয়ার) যা বিশ্বের কল্যানে যা অবদান রাখতে পারে এমন আত্মনির্ভর ভারত গঠনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদান্ত আহ্বানের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
এই চার দিনের বিজ্ঞান উত্সবের লক্ষ্য হল আমাদের দেশের কোমল শক্তিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে শক্তিশালী ও সম্প্রশারিত করা। এছাড়াও যুব ও উদ্ভাবনাময় মনকে আইআইএসএফ ২০২০-র পপ্রতি আকৃষ্ট করতে এসটিইএম জ্ঞানমার্গের অন্তর্গত ৪১ টি বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০২০ যদি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বছর হয়ে থাকে, তাহলে ২০২১ হবে সারা বিশ্বের যে সব মানুষের জন্য এটা অত্যাধিক জরুরী তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি কঠিনতম কাজের বছর।
এই আইআইএসএফ ২০২০, আসুন আমরা এ উপলক্ষে বর্তমান অতিমারির অবসান কল্পে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিকে দ্বিগুণ করতে শপথ গ্রহণ করি এবং বিজ্ঞানকে জীবন রক্ষাকারী করে তুলতে আমাদের সহযোগিতাকে দ্বিগুণতর করি।
সমস্ত রকম ধ্বংসকান্ড সত্বেও ২০২০ হল বৈজ্ঞানিক সাফল্যের এক মহৎ কাহিনী সমৃদ্ধ বছর। আমার কাছে এই বছরটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে এবার বিজ্ঞানীরা হুমকির মুখে মানবিকভাবে প্রথমেই সাড়া দিয়েছেন। একই সঙ্গে, সমস্ত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা, চিকিত্সার ও টীকা সংস্থানের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই বছরটিতেই।
যেসব বিজ্ঞানী কোভিড ভ্যাকসিন, পরীক্ষা ও চিকিত্সার জন্য এবছর অবদান রেখেছেন, আপনাদের জয়ধ্বনি করছি এবং আপনাদের জানাই বিপুল অভিনন্দন, ধন্যবাদ! (লেখক কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পৃথিবী বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী)