নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৯ এপ্রিল৷৷ করোনা মোকাবেলায় লকডাউনেই আস্থা রাখলেন বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব৷ আজ সচিবালয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে উভয়েই লকডাউন নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছেন৷ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা মোকাবেলায় লকডাউন এখন আমাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে৷ কোন না কোন লকডাউনকে সাথে নিয়েই আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে৷ তেমনি বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও বৈঠকে করোনা মোকাবিলায় লকডাউনই একমাত্র অস্ত্র বলে মতামত প্রকাশ করেছেন৷
একটা মহামারিকে মোকাবিলা করছি আমরা৷ একটা সঙ্কট চলছে এখন৷ এই সঙ্কটে সবই সঠিক হবে তা কখনোই ঠিক নয়৷ এই সময়ে সবাইকে একসাথে মিলে মিশে কাজ করতে হবে৷ আজ সন্ধ্যায় মহাকরণে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আহুত সর্বদলীয় বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব একথা বলেন৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই কঠিন সময় থেকে কিভাবে বেড়িয়ে আসা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতেই এই সর্বদলীয় বৈঠক৷ এখানে উপস্থিত সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যেসমস্ত প্রস্তাব ও পরামর্শ এসেছে তা রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগ নেবে৷ উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় আজ বিকেলে রাজ্য সরকারের আহ্বানে মহাকরণের ২নং কনফারেন্স হলে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এই সর্বদলীয় সভায় সভাপতিত্ব করেন৷
সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ত্রিপুরা অনেক এগিয়ে আছে৷ কিছু ভুল ত্রটি থাকলেও চিকিৎসকরা খুব ভাল কাজ করেছেন৷ পি পি ই কিট মজুত রয়েছে ৯০৯০টি৷ ১২৬টি আইসোলেশন বেড রয়েছে রাজ্যে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাস পরীক্ষা হয় একমাত্র মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে৷ ত্রিপুরায় বর্তমানে দু’টি মেশিন রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় আরও একটি মেশিন আনা হবে৷ ইতিমধ্যে জিবি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে৷ খুব শীঘই আই জি এম হাসপাতালেও আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যের বাইরে যারা এখনও আটকে আছেন তাদেরকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছে৷ রাজ্যের বাইরে থেকে যারা আসবেন তাদের এখানে আসার সাথে সাথে স্যাম্পল নেওয়া হবে এবং স্যাম্পলের রির্পোট না আসা পর্যন্ত তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হবে৷
সর্বদলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যে লকডাউন জনিত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ ত্রিপুরা কৃষি নির্ভর রাজ্য৷ গ্রামীণ অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করতে এবং কৃষকদের হাতে যাতে টাকা যায় সেজন্য সরকার আগামী ১৫মে থেকে সহায়ক মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ রাজ্যের প্রায় ৭ হাজার জমিয়াকে বিনামূল্যে জম বিজ এবং ২০২ টাকা করে ৬ শ্রমিদিবসের কাজ দেবে সরকার৷ তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলি থেকে যে পরামর্শ এসেছে তা প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আনা হবে৷ আয়কর দেননা এমন পরিবারদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার যে বিষয়টি সভায় উঠে এসেছে তা সরকার খতিয়ে দেখবে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার ইতিমধ্যে রাজ্যের গরিব মানুষ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত প্যাকেজ অনুসারে সহায়তা দিচ্ছে৷ ইতিমধ্যে এসপিরেশনেল ব্লকের ৯৩ হাজার পরিবারকে ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে৷ এজন্য ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা৷ রাজ্যের ২ লক্ষ ৭৫ হাজার উজ্জলা যোজনায় বেনিফিসিয়ারিদের গরিব কল্যাণ যোজনায় ৩ মাস ফ্রি গ্যাস সিলিণ্ডার দেওয়া হবে৷ সভায় মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দেন উজ্জলা যোজনা সহ সমস্ত গ্যাস ভোক্তাদের বাড়ি বাড়ি গ্যাস পৌঁছে দিতে জেলাশাসকগণ যেন উদ্যোগ নেন৷
এ বিষয়ে কোন এজেন্সি যদি বাড়ি বাড়ি গ্যাস সিলিণ্ডার পৌঁছে দিতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যে ৪ লক্ষ মানুষ সামাজিক ভাতা পান৷ তাদেরকে দু’মাসের ১০০০ টাকা করে ইতিমধ্যেই অগ্রিম দেওয়া হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ভাতা পান ১ লক্ষ ২৯ হাজার মানুষ৷ তাদেরকেও তিন মাসের টাকা দেওয়া হচ্ছে৷ ৪০ হাজার নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ২৪ হাজার নির্মাণ শ্রমিককে ইতিমধ্যেই আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ বিনামূল্যে রেশনিং ব্যবস্থার সুুযোগ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্যে যাদের রেশনকার্ড নেই তাদের কাছে রেশন এবং অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডি এমদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ চা বাগানগুলিতে ফ্রি রেশন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ ২২ হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে আর্থিক সহায়তা এবং রেশন দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্তে কেউ মারা গেলে সরকার ৪ লক্ষ টাকা দেবে৷ এই ঘোষণা সরকার আগেই দিয়েছে৷ ৩৭২ জন প্রত্রিকা হকারদের ১০০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা ও ফ্রি রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার৷
সর্বদলীয় সভায় বিরোধী দলের নেতা মানিক সরকার বলেন, করোনা সংক্রমণ মোকাবেলার একমাত্র অস্ত্র লকডাউন৷ এজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে, জনগণের সহযোগিতা চাইতে হবে৷ সরকারকে অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে এই কাজ করতে হবে৷ তাতে অংশ নিতে হবে আমাদের সবাইকে৷ ঐক্যবদ্ধ ভাবেই এই কাজ করতে হবে যাতে মানুষের মনে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়৷ বিরোধী দলনেতা এই সময়ে যাতে অন্যান্য রোগীরা চিকিৎসার সুুযোগ নিতে পারেন সেজন্য ও পি ডি চালু এবং ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারগুলি চালু করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন৷ সভার শুরুতে শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ সর্বদলীয় সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ত্রিপুরা এখন করোনা মুক্ত৷ কিন্তু আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চাইছি না৷ ত্রিপুরাবাসীকে যাতে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখা যায় সেই লক্ষ্যে আলোচনার উদ্দেশ্যেই আজ এই সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়েছে৷ যাতে সরকার এক সঠিক নির্দেশিকায় করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে পারে৷
সর্বদলীয় সভায় উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা, উপজাতি কল্যাণ মন্ত্রী মেবার কুমার জমাতিয়া, আই এন সি দলের পক্ষে পীযূষ বিশ্বাস, সি পি আই (এম) দলের পক্ষে গৌতম দাস, বিজেপি দলের পক্ষে ডা. অশোক সিনহা, আই পি এফ টি দলের মঙ্গল দেববর্মা, আই এন পি টি দলের জগদীশ দেববর্মা, পি ডি এস দলের পক্ষে প্রাক্তন সাংসদ অজয় বিশ্বাস এবং সি পি আই, আর এস পি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আমরা বাঙ্গালী, এস ইউ সি আই, সি পি আই (এম-এল), লোকজনশক্তি পার্টি, এন সি পি ও ত্রিপরাল্যাণ্ড স্টেট পার্টির প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন৷ তাছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ কুমার, রাজ্য পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহানির্দেশক রাজীব সিং, অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এস কে রাকেশ, প্রধান সচিব (পরিবহণ) এল টি ডার্লং, শিক্ষা সচিব সৌম্যা গুপ্তা, শিল্প ও বাণিজ্য সচিব কিরণ গিত্যে, অর্থ ও রাজস্ব দপ্তরের সচিব তনুশ্রী দেববর্মা, মুখ্যমীর বিশেষ সচিব ড. পি কে গোয়েল, অতিরিক্ত সচিব এন সি শর্মা, খাদ্য দপ্তরের অধিকর্তা তপন কুমার দাস৷ সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং লকডাউন জনিত পরিস্থিতিতে কি কি করতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত প্রস্তাব ও পরামর্শ দেন৷ রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাবও সর্বদলীয় সভায় পেশ করা হয়৷ সভার শুরুতে মুখ্যসচিব মনোজ কুমার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্যাকেজ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরেন৷
সর্বদলীয় বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব সাংবাদিকদের বলেন, করোনা উদ্ভত পরিস্থিতি মোকাবিলায় গরিব সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাজ্য সরকার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিস্তারিত ভাবে বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে৷ রাজ্য সরকার স্বচ্ছতার সাথে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে মানুষের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের যে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছে তা সভায় তুলে ধরা হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা অনেকটাই এগিয়ে আছে৷ মুখ্যমন্ত্রী তথ্য দিয়ে জানান, সারা দেশে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার গড় অনুপাত প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় ৪৭০জন৷ সেখানে ত্রিপুরায় এই গড় অনুপাত প্রায় ১১৮০জন৷ বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ যে সমস্ত প্রস্তাব এনেছেন সেগুলিও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজ্য সরকার গ্রহণ করবে৷ দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে হবে৷
এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সচেতনতার উপর৷ রাজ্য সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে৷ ভয় না পেয়ে সচেতনতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির মোকাবিলার প্রয়োজন বলে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ ৩ মে পর্যন্ত এই লকডাউন বলবৎ রয়েছে৷ তবে এরমধ্যেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকার চালু রাখবে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ৩ মে’র পর গণপরিবহন চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ আন্তরাজ্য পরিবহনও চালু হচ্ছে না৷ তেমনি বিমান ও রেল পথে যাতায়াতও শুরু হচ্ছে না৷ ফলে লকডাউনকে সাথে নিয়েই আমাদের করোনার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে৷ তাঁর কথায়, এখন লকডাউন আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে৷ তাই, কোনও না কোন লকডাউনকে সাথে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে৷ অবশ্য, এদিন তিনি ৩ মে’র পর রাজ্যে সার্বিক লকডাউনের সময়সীমা বৃদ্ধি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি৷