ডাঃ অনুপম মজুমদার
কনস্যালট্যান্ট নেফ্রোলোজিস্ট এন্ড রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফিজিসিয়ান (Consultant Nephrologist & Renal Transplant Physician)
১. কোমরে ব্যথা বা প্রস্রাব লালচে রঙের হলেই কিডনির সমস্যা বলে মনে করা হয়- এটা কি ঠিক
কিছু কিছু কিডনির সমস্যায় এটা হতে পারে। যেমন পাথর হলে, পলিসিস্টটিক রোগ হলে বা কিডনি রোগ থেকে ক্যালসিয়াম কমে গেলে। তবে কোমরে ব্যথা মানে কিডনির সমস্যা তা নয়।
২. কি কি কারণে এইধরণের সমস্যা হতে পারে
যদি কারোর প্রস্টেট এর সমস্যা বা ইউনিনারি ব্লাডারের ক্যান্সার মত সমস্যা হলে এই ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেইজন্য এই রকম সমস্যা দেখা দিলেই যতশীঘ্রই নেফ্রলোজিস্ট দেখানো ও তাঁর পরামর্শমত চিকিৎসা চালানো প্রয়োজন।
৩. কী কী কারণে কিডনি রোগ হয়?
কিছু রোগ আছে যেগুলো সরাসরি কিডনির ক্ষতি করে। আবার এমন কিছু স্টিস্টেমিক রোগ আছে, সেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেহের অন্যান্য অঙ্গের সাথে সাথে কিডনিরও ক্ষতি করে।
উচ্চরক্তচাপ (যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না) ও ডায়াবেটিস (যাদের রক্তে সুগারের পরিমান নিয়ন্ত্রণে থাকে না) থাকলে কিডনির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া
যদি বংশে কিডনি রোগী থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্য কারও সেই রোগ হতে পারে।
যাদের মূত্রে সংক্রমণ থাকে
যাদের কিডনিতে বার বার পাথর হয়
কানেক্টিভ টিসু ডিসওর্ডার যদি হয়
প্রসেস্ট এর সাইজ যদি বড় হয়ে যায়
শরীরের অন্য অংশে যদি কোন ইনফেকশন থাকে
অতিরিক্ত মদ্যপান
জল কম খাওয়া।
৪. কিডনি রোগ হয়েছে কি না—এটা বোঝার উপায় কী?
বোঝার একমাত্র উপায় প্রতি বছর নেফ্রোলজিস্টর পরামর্শ নেওয়া। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে প্রথমেই ইউরিন পরীক্ষা করতে হবে। রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়োটোনিন, হিমোগ্লোবিন, ক্যালসিয়াম, ইউরিক অ্যাসিড এর পরিমান ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে
এছাড়া কিডনির আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে হবে।
তবে যদি ইউরিনের মাধ্যমে
প্রোটিন মাত্রা অতিরিক্ত বেরিয়ে যায়
আর বি সি বেরিয়ে যায়
কিডনির সাইজ যদি ছোট হয়ে যায়
- তাহলে কিডনির রোগ হয়েছে বলে বোঝা যায় ।
৫. কিডনির রোগের লক্ষণ কি?
সাধারণ ভাবে কিডনি রোগের লক্ষণ খুব ভাল ভাবে বুঝা যায় না। যতদিন পর্যন্ত কিডনিটা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ খারাপ না হয় ততক্ষণ বোঝা যায় না। সেইজন্য এই রোগটা সায়েলেন্ট কিলার বলা হয়।
তবে কিছু লক্ষণ দেখা দেয় যেমনঃ-
ক্ষিদে কম পাওয়া
বমি বমি ভাব
ঘন ঘন জ্বর হওয়া
প্রস্রাবে জ্বালা
মাথা ঘুরানো
দুর্বল লাগা
চোখের পাতা ফুলে যাওয়া সকালে দিকে পা ফুলে যাওয়া
হঠাৎ করে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়া
অ্যানিমিয়া হওয়া
৬. আধুনিক জীবনযাত্রার মান কিডনির সমস্যা বাড়ার কি মূল কারণ
ব্যস্তময় ইঁদুর দৌড় জীবনযাপন, মানসিক চাপ, উত্তেজনা, ফাস্ট ফুড, শাকসবজিতে কীটনাশক, পরিবেশ দূষণ, নেশা, অনিয়মিত জীবনযাত্রা, বেশী পরিমানে লবণ, মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া – নিঃসন্দেহে আধুনিক এই জীবনশৈলী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কিডনি খারাপ হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
৭. কি কি লক্ষণ দেখলে রোগী বুঝবে যে তার কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া অবশ্যক
ইউরিনে ফেনা হওয়া
সকালে ঘুম থেকে উঠলে মুখ ফুলা পা ফুলা
অ্যানিমিয়া
প্রস্রাব লাল হওয়া
তাছাড়া প্রস্রাব কম হওয়া,
শ্বাসকষ্ট হওয়া
৮. কিডনি রোগ কি নিরাময়যোগ্য?
কিছু কিছু কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিরাময় করা সম্ভব। তবে বাকিগুলি কন্ট্রোল করা সম্ভব।
৯. কিডনি রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা কী?
- USG(KUb)
- ইউরিনের রুটিন চেক আপ
- মূত্রে অ্যালবুমিন ও ক্রিয়োটোনিন সমতা পরীক্ষা (urine for ALBUMIN: CREATININE RATIO)
- এবং প্রয়োজন হলে অনেক ক্ষেত্রে কিডনি বায়োপসি করতে হয়।
১০. ডায়াবেটিস যাদের থাকে তাদের কি কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে
কিডনির রোগের প্রধান কারণ হল ডায়াবেটিস। যাদের ডায়াবেটিস থাকে তাদের ৫০ শতাংশেরও বেশী লোকেদের ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে। নিয়মিত চেক আপের মাধ্যে থাকলে ডায়াবেটিস যে কিডনিটার ক্ষতি করতে যাচ্ছে তা বোঝা যায়। এবং সেটা করা গেলে ওষুধের মাধ্যমে কিডনিটা খারাপ হওয়ার গতিটাকে অনেকটা ধীরে করে আনা সম্ভব হয়।তাছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের নন-ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজ ও হতে পারে।
১১. কখন কিডনি ফেলিউর বলা হয়?
যখন বিভিন্ন অসুখের কারণে কিডনিদুটি কাজ স্বাভাবিক ভাবে করতে পারে না বা কিডনি কার্যক্ষমতা কমে যায় যায় তখন কিডনি ফেলিউর বলা হয়। যখন হাই লেভেল ইউরিয়া যায় এবং তার সঙ্গে অন্যান্য অ্যাবনরম্যাল হয়ে যায়। প্যারমিটারগুলি যেমনঃ-
রক্তল্পতা হতে পারে
ইউরিক অ্যাসিড এবং ফসফেট এর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
ক্যালসিয়াম কম হয়ে যেতে পারে।
হাড় এ ব্যথা হতে পারে।
ক্রিয়োটোনিন এবং ইউরিয়া লেবেল বেড়ে যেতে পারে।
ইলেক্টোলাইট অ্যাবনরমাল হতে পারে।
১২. ডায়ালোসিস করা বা কিডনি প্রতিস্থাপন কখন করার প্রয়োজন হয়
যখন কিডনি ৯০ শতাংশ খারাপ হয়ে যায় এবং তার সাথে অসহ্যকর কিডনি ফেলিওর লক্ষণগুলি চলে আসে।
১৩. কিডনি সুস্থ ও সবল রাখতে আপনার পরামর্শ।
নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ / রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
ইউরিনে জ্বালা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
পর্যাপ্ত পরিমানে জল (২ থেকে ২.৫ লিটার) খাওয়া
নুন কম খাওয়া
ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলা
মাদক দ্রব্য না খাওয়া
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
সকাল বিকালের খাবার সঠিক সময়ে খাওয়া
যতটা সম্ভব মানসিক চাপ, উত্তেজনাকে এড়িয়ে চলা।
বছরে অন্ততঃ একবার কিডনির কোনো সমস্যা আছে কি না সেটা জানার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।