নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৯ সেপ্টেম্বর৷৷ দুর্গাবাড়িতে নবমী পুজায় মহিষ বলির প্রথা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে৷ কিন্তু, হাইকোর্টের রায়ে পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা প্রশাসনে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে৷ দূুর্গাবাড়িতে ওই বলি নিয়ে জেলা প্রশাসন ভিষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে৷ এদিকে, শনিবার দিনভর টানাপোড়েন শেষে অমাবস্যার নিশিরাতে উদয়পুরে মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে বলি সম্পন্ন হয়েছে৷ ত্রিপুরা হাইকোর্টের পশু-পক্ষী বলি নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আদেশের জেরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান মন্দির কর্তৃপক্ষ৷ তার ওপর প্রশাসন থেকে বলি-নিষেধাজ্ঞার কাগজ মন্দিরে সেঁটে দেওয়ার সাথে সাথে দ্বন্দ্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷ এ-সবের জন্য প্রশাসনিক অজ্ঞতা দায়ী, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ কারণ, হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঠিকই৷ কিন্তু সেই আদেশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ত্রিপুরা সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে৷ রাজ্য সরকার এ-বিষয়ে এখনও কোনও বিজ্ঞাপ্তি জারি করেনি৷ ফলে অনভিজ্ঞ প্রশাসনিক আমলাদের অতি উৎসাহ দিনভর মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে এক অস্থিরতা কায়েম করে রেখেছিল৷

রবিবার পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা প্রশাসন দুর্গাবাড়িতে নবমীতে মহিষ বলি নিয়ে এক বৈঠক করেছেন৷ জেলা আধিকারীকদের এক প্রতিনিধি দল এদিন মন্দিরের পুরোহিত ও অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করেছেন৷ তবে, আলোচনায় কি বেড়িয়ে এসেছে তা জানাতে রাজি হননি জেলা প্রশাসনের আধিকারীকরা৷ নবমীতে দুর্গাবাড়িতে মহিষ বলি হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট হয়ে উঠেনি৷ হাইকোর্টের রায় মানলে মহিষ বলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত জেলা প্রশাসনের৷ কিন্তু, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন কিছুটা চিন্তিত৷ তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই মনে করা হচ্ছে৷
এদিকে, গোমতি জেলার উদয়পুর মহকুমায় অবস্থিত মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে বলিপ্রথা বহু যুগ ধরে চলছে৷ প্রতিদিন মায়ের আরাধনায় বলি দেওয়া হয়৷ ধর্মপ্রাণ মানুষরা মানত করেন বলি দিয়ে মায়ের নামে তা উৎসর্গ করবেন৷ এই বিশ্বাস বহুকাল ধরে চলে আসছে৷ মহারাজ গোবিন্দ মানিক্য বলিপ্রথা বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রাচীন ওই রীতি ত্রিপুরায় এখনও চলছে৷ গত শুক্রবার ত্রিপুরা হাইকোর্ট রাজ্যের সমস্ত মন্দিরে বলি নিষিদ্ধ বলে রায় দিয়েছে৷ এতে অবশ্য ত্রিপুরায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছে৷ বলিপ্রথা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে৷ কিন্তু, হাইকোর্টের রায় এখনও ত্রিপুরায় সরকারিভাবে কার্যকর করতে কোনও ঘোষণা হয়নি৷
শনিবার রাতে পঞ্জিকা মতে অমাবস্যা তিথি ছিল৷ প্রতি অমাবস্যা নিশিরাতে মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে একটি মহিষ এবং পাঁচটি পাঁঠা বলি দেওয়ার বহু পুরনো রেওয়াজ রয়েছে৷ এর জন্য লটারির মাধ্যমে বাছাই করা হয়. মহিষ এবং পাঁঠা কে উৎসর্গ করবেন৷ প্রতি অমাবস্যায় বলির জন্য বাছাই প্রক্রিয়া এক মাস আগেই সম্পন্ন হয়ে যায়৷ এ-ক্ষেত্রেও সমস্ত আগেই স্থির করা ছিল৷ সেই মোতাবেক আয়োজনও করা হয়েছিল৷ কিন্তু শনিবার দুপুরে প্রশাসনের তরফে বলি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বোর্ড টাঙিয়ে দিতেই অস্থিরতা দেখা দেয় মন্দিরে৷
গোমতির জেলাশাসক টিকে দেবনাথ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বর্তমানে রাজ্যের বাইরে৷ ফলে তাঁর অবর্তমানে জেলা প্রশাসনের জনৈক আধিকারিকের সাথেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি৷ এ-বিষয়ে মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত চন্দন চক্রবর্তী বলেন, বহু প্রচলিত রীতি মেনেই প্রতি অমাবস্যা রাতে মহিষ এবং পাঁঠা বলি দেওয়ার প্রথা চলছে৷ সে অনুযায়ী মহিষ এবং পাঁচটি পাঁঠা নিয়ে পুণ্যার্থীরা এসে গেছেন৷ কিন্তু তাঁদের বলির টোকেন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ কারণ মন্দির কর্তৃপক্ষ দ্বন্দ্বে পড়েছেন৷
ওইদিন মন্দিরে সকালে ১০১টি বলি হয়েছে৷ তার মধ্যে একটি ছিল সরকারি৷ কিন্তু দুপুরের পর থেকে সরকারি আদেশে মন্দির চত্ত্বরে অস্থিরতা তৈরি হয়ে যায়৷ পুরোহিত চন্দন চক্রবর্তী বলেন, জেলা কিংবা মহকুমা প্রশাসনের তরফে লিখিত কোনও আদেশ জারি করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু টেলিফোনে ত্রিপুরা হাইকোর্টের আদেশ পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ এমন-কি বলি নিষেধ এমন একটি বোর্ডও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে মন্দির চত্ত্বরে৷
দিনভর এই টানাপোড়েনের পর অবশেষে নিশিরাতে বলি সম্পন্ন হয়েছে৷ এ-বিষয়ে পুরোহিত চন্দন চক্রবর্তী জানান, বলি বন্ধের জন্য লিখিত আদেশ মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়নি৷ তাই আপাতত আদালতের আদেশ পালন করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে না৷ তাছাড়া, রীতি ভঙ্গ হোক, তা-ও চাই না আমরা৷
এ-বিষয়ে খবর নিয়ে জানা গেছে, ত্রিপুরা সরকার এখনও হাইকোর্টের রায় নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ সূত্রের খবর, আদালতের ওই রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবে ত্রিপুরা সরকার৷ সম্ভবত, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর প্রস্তুতি চলছে৷ তাই, ওই রায় নিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ত্রিপুরা সরকার বলি বন্ধে কোনও বিজ্ঞাপ্তি জারি করবে না বলে সূত্রের দাবি৷ তাছাড়া হাইকোর্ট এখনই বলি বন্ধ করে দিতে কোনও আদেশ দেয়নি৷ হাইকোর্ট রায়ে সাফ বলেছে, ত্রিপুরা সরকারকে এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে৷ সাথে ওই রায়ের কার্যকারিতা সারা ত্রিপুরায় প্রচার করতে হবে৷ কিন্তু, গোমতি জেলা প্রশাসন বলি বন্ধে হঠাৎ এত উৎসাহী কেন হল, তার কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ একই কাজ পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও হয়েছে৷ আগরতলার দুর্গাবাড়িতে শনিবার একটি বলি হওয়ার কথা থাকলেও, তা বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন৷ স্বাভাবিকভাবেই আদালতের এই রায়কে ঘিরে সারা ত্রিপুরায় এক অস্থিরতা কায়েম হয়েছে৷

