কলকাতা, ৪ সেপ্টেম্বর (হি.স) : সোমবার বিজেপির ডাকা ১২ ঘন্টা বারাকপুর বনধকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত রইল রাজ্য পরিস্থিতি | সকাল থেকেই বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় চলে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ |এদিনও ফের একবার পুলিশ-বিজেপি কর্মীদের সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিভিন্ন এলাকা| জখম হয় ১৫ জন বিজেপি কর্মী | এসবের সঙ্গেই এদিন সকালে কঁকিনাড়ায় রেল অবরোধের জেরে নাজেহাল হতে হয় যাত্রীদের | এদিন এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয় রাজ্য রাজনীতি | চলে দোষারপের পাল্টা দোষারোপ |
অন্যদিকে এদিনের এই হিংসার পরিস্থির জন্য অর্জুন সিংকেই দায়ী করেন রাজ্য পুলিশের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জ্ঞানবন্ত সিং । সব মিলিয়ে এদিন সাংসদ অর্জুন সিংয়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে, বিজেপির ডাকা বনধের আঁচকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিভিন্ন জেলা ।
সোমবার বিজেপির ডাকা বনধ চলে সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত | রেলকে এই বনধের আওতায় না রাখা হলেও, এদিন সকাল ৬ টা থেকেই কঁকিনাড়া স্টেশনে রেল অবরোধে নেমে পরেন বিজেপি কর্মীরা | রেল অবরোধ চলে কাঁচড়াপাড়াতেও | যার জেরে বেশ কিচ্ছুক্ষন ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয় শিয়ালদাহ মেইন লাইনে | সমস্যায় পড়েন যাত্রীরা । এছাড়াও প্রভাব পড়ে ফেরি চলাচলেও । নৈহাটি, জগদ্দল, বারাকপুর থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় । অন্যদিকে বেলা গড়তেই বারাকপুরের সুভাষনগর কলোনিতে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষ ঘিরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় পরিস্থিতি । আহত হন বেশ কয়েকজন । জোর করে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামানো, অটো ভাঙচুর-সহ একগুচ্ছ অভিযোগ ওঠে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে । বিজেপি তৃণমূল সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বারাকপুরের নোনা চন্দনপুকুর এলাকা, ঘোষপাড়া রোড । এখানেও আহত হন বেশ কয়েকজন । লালকুঠিতে চলে বিজেপি কর্মীদের পথ অবরোধ । উত্তেজনার আঁচ পড়ে টিটাগড়ের কয়লাপুর মোড়, আমডাঙা-রাজবেড়িয়া মোড়, নীলগঞ্জ রোড । একাধিক জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকরা । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ । এদিন পুলিশের লাঠিচার্জের জেরে আহত হন ১৫ জন বিজেপি কর্মী । তাদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে ।
ঘটনার আঁচ পড়ে কার্যত গোটা রাজ্যেই । বিভিন্ন জেলায় পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকরা । দত্তপুকুর থানার যশোর রোডের জয়পুর এলাকায় বিজেপি টায়ার ও গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ শুরু করে । তৃণমূল বাধা দিলে দুপক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয় । আহত হন কমপক্ষে ১০ জন । সেইসময় অবরোধকারীরা কয়েকজন সাধারণ মানুষের বাইক ভাঙচুর করেন বলেও অভিযোগ। পরে দত্তপুকুর থানার পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে ।
পুলিশ সুপার অফিস ঘেরাও অভিযান চলে বিভিন্ন জায়গায় | কৃষ্ণনগর পুলিশ সুপারের দফতরের কাছে কালেক্টরি মোড়ে বিজেপি বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে । সেখানে আটকে দেওয়া হয় বিক্ষোভ মিছিল । পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা । সাময়িক উত্তেজনা ছড়ায় । পুলিশ সুপার অফিস ঘেরাও অভিযান চলে বর্ধমানেও । পুলিশ তাদের পথ আটকালে বিজেপি সমর্থকরা একটি ব্যারিকেড তুলে ফেলেন । পুলিশ লাঠিচার্জ করলে বিজেপি কর্মী সমর্থকেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । পরে মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হয় সেখানে । কার্জনগেটের সামনে আবার বিজেপি কর্মীরা জড়ো হলে পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে । হাওড়া পুলিশ কমিশনারের অফিস ঘেরাও অভিযানে নামে বিজেপি । কয়েকশো কর্মী সমর্থক বার্ন স্যান্ডার্ড মোড় হয়ে হাওড়া পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন । পুলিশকে ঘিরে দেখানো হয় বিক্ষোভ । বিক্ষোভের আঁচ পড়ে দক্ষিণ দিনাজপুরেও । এদিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ বালুরঘাট পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে মঞ্চ বেঁধে অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হন তাঁরা । বারাকপুর, জগদ্দল, কাঁকিনাড়া তো বটেই, বিজেপির বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘিরে সোমবার দিনভর উত্তপ্ত থাকে গোটা রাজ্য | যদিও সবচেয়ে এদিন হিংসার আঁচ বেশি থাকে বারাকপুরে |
অন্যদিকে রবিবার ও সোমবার বারাকপুরের এই গোটা হিংসার ঘটনার জন্য বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংকেই দায়ী করেন রাজ্য পুলিশের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জ্ঞানবন্ত সিং । নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি বলেন, “বারাকপুরে হিংসার ঘটনা ঘটেছে বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংয়ের নেতৃত্বেই | এমনকি রবিবারও ওনার সমর্থকদের ছোঁড়া পাথরেই আহত হয়েছেন তিনি |” সোমবারের বনধের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এডিজি বলেন, “এদিন ছোটখাট কিছু ঘটনা ঘটেছে । এমনিতে পরিস্থিতি পুলিশের আয়ত্তের মধ্যেই ছিল ।”
জ্ঞানবন্ত সিং এর এই মন্তব্যের পরেই এদিন তাঁকে কটাক্ষ করেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ | তিনি বলেন, “ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কমিশনার লাঠি হাতে ছুটছেন । বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছেন | একটি পাড়ার ঝামেলা মেটাতে পুলিশ কমিশনারকে এই কাজ করতে হচ্ছে ।” পুলিশের প্রতি তোপ দেগে দিলীপ ঘোষ বলেন, “এদের (পুলিশের) যোগ্যতা হল যারা তাঁবেদার । ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ের প্রণাম করছেন । ভালো জায়গায় পোস্টিং নেওয়া এবং প্রোমোশনের জন্য পা ধরতে হচ্ছে । আর যারা পা ধরে বোরো হয়েছেন, তাদের থেকে ভালো কাজ আশা করা যায় নাকি ।” তাঁর কথায়, “রবিবার গুন্ডা পুলিশ বিজেপির ওপর আক্রমণ করেছিল । কাঁচরাপাড়ায় পুলিশকে দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে । সাংসদ, বিধায়করাই সুরক্ষিত নন । সাধারণ মানুষ কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে ?”
যদিও এপ্রসঙ্গে জ্ঞানবন্ত সিং –এর বক্তব্য, “পুলিশ লাঠি মারলে গায়ে মারে, মাথায় মারে না । বারাকপুরের পুলিশ কমিশনার ভেবেছিলেন তিনি নিজে গিয়ে বললে অবরোধকারীরা উঠে যাবেন । কিন্তু তা তো হয়ইনি । সঙ্গে সঙ্গে ওরা বোমা ছুড়তে শুরু করে । ফিডার রোডের গণ্ডগোলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অর্জুন সিং-এর ছেলে তথা ভাটপাড়ার বিধায়ক পবন সিং । তারপর যা হিংসার ঘটনা ঘটেছে, সবটাই অর্জুন সিং-এর নেতৃত্বে । ওনার সমর্থকরাই পাথর ছুঁড়েছে । পুলিশ বারণ করেছিল, থামানোর চেষ্টা করেছিল । সেইসময় ওনারই কোনও সমর্থকদের ছোঁড়া পাথর লেগেছে অর্জুন সিংয়ের মাথায় ।” তাঁর কথায়, “পুলিশ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে । কোথাও দেখা যায়নি পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে । পুলিশ যে ভাবে কাজ করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে, কারা পুলিশের উপর পাথর ছুড়ছে ।”
যদিও আহত বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং বারবারই দাবি করে এসেছেন, ইঁটের ঘায়ে নয়, পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফেটেছে তাঁর ৷ এমনকি এদিন এবিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকেও কাঠগড়ায় তুলে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন বিজেপির অন্যতম নেতা মুকুল রায় | এদিন মুকুল রায় বলেন, “অবিলম্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করতে হবে । অর্জুন সিংকে তিনিই খুন করতে চেয়েছিলেন কাল ।” এদিনের এই পুরো বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেই আশ্বাস দেন এডিজি আইনশৃঙ্খলা জ্ঞানবন্ত সিং | তিনি বলেন, “ রবিবারের ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে । সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে । প্রত্যেককে গ্রেফতার করা হবে ।”
অন্যদিকে, এদিন আহত বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-কে দেখতে সোমবার অ্যাপোলো হাসপাতালে যান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকার । তাঁর অবস্থা এখন কিছুটা স্থিতিশীল বলেও এদিন জানায় হাসপাতাল কতৃপক্ষ | এদিন হাসপাতালে আক্রান্ত বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংকে দেখে বেরিয়ে বললেন রাজ্যপাল বলেন, “রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকা প্রয়োজন । রাজ্যে যা ঘটছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক । সাংসদের ওপর এধরনের হামলা নিন্দনীয়। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব ।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে বিষয়টি জানাবেন বলে জানান রাজ্যপাল । তবে শুধু সাংসদের ওপর হামলা নয়, যেভাবে রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক, শিক্ষকরাও হামলার মুখে পড়ছেন, এদিন তার তীব্র নিন্দা করেন তিনি । রাজ্যপাল বলেন, “রাজ্যের উচিত উন্নয়নের দিকে নজর রাখা । কিন্তু রাজ্যে ক্রমেই আইন শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে ।” এদিন রাজ্যপালের এই মন্তব্য যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা । এছাড়াও এদিন অর্জুন সিং-এর সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে যান কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, মুকুল রায় প্রমুখ বিজেপি-র নেতৃবৃন্দ ।
এদিন রাজ্যের ২৩ টি জেলায় পুলিশ সুপারের অফিস ঘেরাও ছাড়াও তৃণমূলের লাগাম ছাড়া সন্ত্রাসের প্রতিবাদে সোমবার থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ে তিন দিনের অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে বিজেপি । আজ এই কর্মসূচির সূচনা করেন বিজেপির নির্বাচণ কমিটির আহ্বায়ক মুকুল রায় । এদিন বিজেপির সাধারণ সাধারন সম্পাদক সায়ন্তন বসু কলকাতায় বলেন, “শুধু সন্দেশখালি নয় । যে ভাবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও বিজেপির সাংসদ অর্জুন সিং এর উপর আক্রমণ করা হল । তার প্রতিবাদেই এই অবস্থান বিক্ষোভ । আজ যদি বিজেপির রাজ্য সভাপতির উপর হামলা হয় তা হলে বিজেপির সাধারণ কর্মীদের নিরাপত্তা কোথায় । পুলিশ প্রশাসন পুরোপুরি দলদাসে পরিণত হয়েছে ।”
এদিন বিজেপির নেতৃত্বের বক্তব্যের বিপরীতে থেকে পুলিশেরই পাশে দাড়ান পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম | তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে থেকে একটা অঞ্চলকে সমাজবিরধীদের হাতে তুলে দেওয়া যায়না | ভাটপাড়ার মানুষ অনেক সহ্য করেছে | দিনের পর দিন বোমাবাজি, গুন্ডামি, ধর্মস্থানে বোমাবাজি এসব হয়ে চলেছে | মানুষ উত্কন্ঠার মধ্যে থেকেছে | তাই পুলিশ কখনও নিরব দর্শক হতে পারে না | তাই পুলিশ আকশন নেবে | এবং দুস্কৃতিদের গ্রেফতার করবে ও যথাহত ব্যবস্থা নেবে সেটাই স্বাভাবিক |”