ঢাকা, ২৫ মে (হি.স.) : ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও মরিয়া হয়ে চেষ্টা করবে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি গত বারের চাইতেও প্রবল শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে এমনই আভাস পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নানাভাবে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, যেহেতু আওয়ামি লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের ঐতিহ্যগতভাবে একটা সম্পর্ক আছে, নরেন্দ্র মোদী সে পথে হাঁটবেন না। কিন্তু ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন হয় না ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়, এই সত্যটি তাদের বুঝতে সময় লেগেছিল। ২০১৪ সালে মোদীর জয়ের পর বাংলাদেশ থেকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু আওয়ামি লিগের সঙ্গে সম্পর্কের ওপরই মোদি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। মোদির প্রথম জমানায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা গত পাঁচ বছরে দিল্লিতে দৌড়ঝাঁপ কম করেননি। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, বিএনপি ভারতের আরও ভালো বন্ধু হতে পারে। আওয়ামি লিগের চাইতেও। ভারতের থিংক ট্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বিএনপি নেতাদের। খালেদাপুত্র লন্ডনে বসে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বারবার। এই কয়েক বছরে ভারত বিরোধিতার মাত্রা কমিয়ে এনেছে বিএনপি। নির্বাচনে ভারতের নাম উচ্চারণও করেনি। কারণ অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বিএনপি নেতারা এখন বুঝতে পেরেছেন, ভারতের ‘সুদৃষ্টি’ ছাড়া এগুনো সম্ভব নয়।
বিএনপির জন্ম ও রাজনীতির ভিত্তিই ছিল ভারত বিরোধিতা এবং ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে রাজনীতি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান আওয়ামি লিগকে ঘায়েল করতে রাজনীতির এই কৌশলকেই অবলম্বন করেন। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, একাত্তরে ভারতের মাটিতেই আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খুনিদের নেতা খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেই ভারতের সাথে দেয়াল তুলে দেয়ার কাজ শুরু করেন। আওয়ামি লিগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে জিয়ারও হাত ছিল, তিনি নেপথ্যে কাজ করেন। জিয়া দেশে ইসলামি ধারা কায়েমের ওপর জোর দেন, সংবিধানকে ইসলামিকরণ শুরু করেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তি, গোঁড়া ইসলামি শক্তি ও চিনপন্থী অতিবাম শক্তিগুলোকে এক করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। সৌদি আরব ও চিন, যে দুই দেশ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর স্বীকৃতিও দেয়নি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেন। এক পর্যায়ে মুসলিম বাংলা কথাটিও চালু হয়। উল্লেখ্য, সৌদি আরব ও চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। জিয়াউর রহমানের সময় ভারতবিরোধী রাজনীতি, শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তির নামে সংখ্যালঘুদের জায়গাজমি দখল ও নির্যাতন চরম আকার ধারণ করে। দেশত্যাগ বেড়ে যায়। অন্যদিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ এবং এদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ করতে সহায়তা দেয় বিএনপি সরকার। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শীর্ষ নেতারা রাজধানী ঢাকায় বহাল তবিয়তে অবস্থান করেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সাহায্যের কথা গোপন থাকেনি।
জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনীর এক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে আসেন। কয়েক মাস পরেই বিএনপি সরকারকে সরিয়ে জিয়া-পরবর্তী সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক নীরব অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিতে গিয়েও ‘জিয়া-তত্ত্ব’ পরিত্যাগ করেনি বিএনপি। পরবর্তীতে এরশাদকে হটাতে আওয়ামি লিগ, বিএনপি ও বামজোট এক সঙ্গে গণআন্দোলন করলেও বিএনপি তাদের ভারতবিরোধী রাজনীতির কৌশল পরিবর্তন করেনি। পরবর্তী সময়ে এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৯১ সালে এবং ২০০১ সালে দুবার ক্ষমতায় আসে। অপরিবর্তিত থাকে রাজনীতির হাতিয়ার। ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতবিরোধী রাজনীতি আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালে। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল আলফা বিদেশ থেকে জাহাজে আমদানি করা দশ ট্রাক অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে স্থলপথে নেয়ার সময় দুই পুলিশের (তারা জানতো না যে এই অস্ত্র ধরতে নেই) কাছে ধরা পড়ে, গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বেকায়দায় পড়ে। কিন্তু এই দুই পুলিশকে চাকরিচ্যুত করায় সরকারের অবস্থান প্রকাশ হয়ে পড়ে।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেন, বিতাড়িত করেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। গ্রেফতার করা হয় আলফার শীর্ষ নেতাদের। পরবর্তীতে তাদের তুলে দেওয়া হয় ভারতের হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মদদ পেতে শুরু করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ফের ক্ষমতায় আসার পর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে আবার কঠোর অবস্থান নেন।
গত দশ বছরে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থেকে বিএনপি অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। বিএনপি এখন অস্তিত্ব সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে। বিএনপির অন্তত দুই শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না শর্তে হিন্দুস্থান সমাচারকে বলেছেন, বিএনপির রাজনীতি ভুল ছিল। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অন্যতম পরাশক্তি ভারতকে শত্রু বানিয়ে আমরা এগুতে পারবো না এই উপলব্ধি অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।
শুক্রবার সকালে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নরেন্দ্র মোদীকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হবে নরেন্দ্র মোদির কাছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চিঠিও।
বিএনপির বিদেশনীতি নিয়ে কাজ করেন, এমন একাধিক নেতা জানান, দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ঘাটতি ছিল দলের। ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর থেকে একাধিক ঘটনায় ভারতের সঙ্গে দলীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটায় বিএনপি। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সাল এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে অনেকটা প্রকাশ্যেই আওয়ামি লিগকে সমর্থন দেয় ভারত।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, দলীয়ভাবে বিএনপি প্রতিবেশী ভারতের সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। তবে নরেন্দ্র মোদী টানা সরকারে আসায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চাইছে সম্পর্ক নতুনভাবে ঝালাই করতে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বিএনপির কাক্সিক্ষত সম্পর্কের বিষয়টি গত কয়েক বছরে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিল, নির্বাচনের আগে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা ও কারাবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যেও উঠে এসেছে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মাটিকে কোনোভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না এখন এমন বক্তব্য রাখছেন নেতারা। ‘ভিশন ২০৩০’-এর পররাষ্ট্রনীতি’র একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘বিএনপি অন্য কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অন্য কোনও রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে না। মূলত ২০১২ সালের শেষদিকে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির সরে আসার ইঙ্গিত মেলে।
শুক্রবার সকালে গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ফরেন উইংয়ের টিমলিডার আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভারতের নির্বাচনের গভীর প্রশংসা করে বলেছেন, ভারতের নির্বাচনের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, তাদের জনগণ ভোটের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পেরেছে। যেটা বাংলাদেশে জনগণ পারেনি। ভারতের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছে। গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও গতিশীল ও শক্তিশালী করেছে।