শান্তিনিকেতন, ১৬ আগস্ট (হি.স.): গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি বাড়তি অনুরাগ ছিল কবি অটলবিহারী বাজপেয়ীর। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাকে এতটাই আকর্ষন করত যে কবির “ভারত তীর্থ” কবিতা হিন্দি অনুবাদ চেয়েছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী | বাজপেয়ীর সহপাঠী তথা বিশ্বভারতীর হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক রামসিং তোমারকে এই অনুরোধ করেছিলেন তিনি | বাংলা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান রামবহাল তিওয়ারির সহযোগিতায় ওই কবিতা হিন্দিতে অনুবাদ করে বাজপেয়িকে দেওয়া হয়েছিল।
বাগ্মী কবি রাজনেতা তথা আচার্যকে হারিয়ে স্মৃতি মেদুর শান্তিনিকেতন। বিশ্বভারতীর ১০ তম আচার্য রুপে দায়িত্ব নেন দেশের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজেপেযী। কিন্ত আচার্য রূপে দায়িত্ব নেবার অনেক আগে থেকেই তার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। এমন কি বিশ্বভারতী প্রতিছিল তার যথেষ্ট অনুরাগ।
বিশ্বভারতী এলেন ২০০১ সালে স্বয়ং বিশ্বভারতীর আচার্য্য রূপে। উপলক্ষ অবশ্যই বিশ্বভারতী সমাবর্তন। ১৫ ডিসেম্বর কনভোকেশন দিন স্থির হযেছিল। কিন্ত তার আগেই সংসদ ভবনে হামলার ঘটনা ঘটে গেল। বিশ্বভারতীর কতৃপক্ষ সমাবর্তনে ব্যবস্থা প্রায় সেডে ফেলেছেন। এত করেও কতৃপক্ষ বার বার চিন্তা করছেন। ঐ বোধ হয প্রোগ্রাম বাতিল হযে যাবে।
তৎকালীন উপাচার্য সুজিত বসু বলেন, আমি জুন মাসে যোগদান করলাম বিশ্বভারতী তে। এসেদেখি দু তিন বছর সমাবর্তন হয় নি। প্রচুর ছাত্রছাত্রী সার্টিফিকেট আটকে আছে। আচার্যকে জানালাম। তিনি সন্মতি জানালেন। দিন ঠিক হল। কিন্ত সংসদ হামলায় সব টলমল হযে গেল।কিন্ত সেই সময় বাজেপেযী আগ্রহের কারনে তা সম্ভব হযেছিল ”
জানা গেছে,” একদিকে সংসদে হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা চরম ভাবে বাড়ানো হযেছে। যা নিযে নিরাপত্তা এজেন্সি বাজেপেযী আসা নিযে খুব দরকষাকষি করছে। তারমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানালো বিশ্বভারতী কনভোকেশনে যে শোভাযাত্রা হয় তাতে হাঁটতে পারবে না প্রধানমন্ত্রী। কারন হাঁটুর যন্ত্রনায় কাতর প্রধানমন্ত্রী। ডাক্তারের নিষেধ। আকাশ ভাঙল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কারন। একদিকে বিশ্বভারতী ঐতিহ্য অন্যদিকে আচার্য অসুস্থতা সহ আসছেন।
এই অবস্থায় মুস্কিল আসান সেই বাজেপেযী নিজে। ডাক্তার সঙ্গে পরামর্শ করে ২৬ পা হাঁটতে পারবেন শুনেই আচার্য অটল বিহারী বাজেপেযী শান্তিনিকেতন আমর কুঞ্জে মাঝখানে আলপনা দেওয়া রাস্তা দিযে হাটলেন আচার্য। ঐতিহ্য মেনে হেঁটে উঠলেন জহরবেদীতে।
সেদিনের সেই কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিমেদুর প্রাক্তন উপাচার্য সুজিত বসু বলেন, ” আমাদের জানানো হল উনি ২৬ পা মত হাঁটবেন। সেই মত সকল অধ্যাপক অধ্যাপিকারা আধিকারিকরা শোভাযাত্রা করে এলেন আমরকুঞ্জে আচার্য যোগ দিলেন শোভাযাত্রা।ওনার বিশ্বভারতী নিযে খুব উৎসাহ ছিল ” তবে শুধু সমাবর্তনে শোভাযাত্রা হাঁটা নয়। পাযের সমস্যা কারনে উনি সমাবর্তন মঞ্চে বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারবেন না। তাই আচার্য হাত দিযে সকল সফল ছাত্রছাত্রীদের দাঁড়িয়ে সার্টিফিকেট এবং সপ্তপরনী দিতে পারবেন না। ঠিক হল ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিনিধি হিসাবে উপাচার্য তা আচার্য কাছে গ্রহন করবেন। সেই মত সব ঠিক ঠাক চলছিল। হঠাৎ হিন্দী ভবনের ছাত্রী প্রতিভা সিং চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন আচার্যকেই সার্টিফিকেট দিতে হবে।
আচার্য বাজেপেযী পাশে বসা উপাচার্য সুজিত বসুকে জিজ্ঞেস করেন, কি হযেছে। উপাচার্য কারন জানাতে মাইক চেয়ে নেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তথা আচার্য। সেদিনের কথা জানালেন প্রাক্তন উপাচার্য সুজিত কুমার বসু তিনি বলেন, “আচার্য সার্টিফিকেট দেবে না কেন এই বলে দল পাকাচ্ছে কিছু ছাত্রছাত্রী।বাজেপেযীজী জিজ্ঞেস করলেন কি হযেছে? ওরা চিৎকার করছে কেন? আমি বললাম ওরা আপনার হাত থেকে সার্টিফিকেট নেবে। না হলে নেবে না। এই কথা বলা মাত্র আচার্য বাজেপেযী জী বললেন আমাকে মাইক দাও। মাইক হাতে নিযে বলে উঠলেন,” কি করবে বল। তোমাদের আচার্য বেশী ক্ষন দাঁড়াতে পারেন না। কি করবে বল। বসে তো আর ঐতিহ্য মেনে সপ্তপরনী দেওয়া যায় না। সমাবর্তন মঞ্চে ফের কিছুটা সময় থেমে গিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ি বলেছিলেন, “ঠিক কথা, কিন্তু, দুঃখের বিষয় তোমাদের আচার্যকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করে দেওয়া হয়েছে।” অনুষ্ঠানস্থানে সকলেই এই কথা শুনে হেসে ফেলেছিলেন। পড়ুয়াদের ক্ষোভও প্রশমিত হয়েছিল।এমনই এমন কিছু কথা বললেন যে মুহূর্তে সবাই শান্ত হযে গেলেন। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব।
সেই সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন হিন্দি ভবনে অধ্যাপক চক্রধর ত্রিপাঠি বলেন,” বাজেপেযী জী তার ভাষনে রবীন্দ্রনাথ গান – “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায রে” এর কথা উল্লেখ করে কবি গুরুর এই আশ্রম বিদ্যালয়ের উৎকর্ষ বৃদ্ধির কথা বলেন। কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী একটু চিৎকার করলেন তার আপন করা বক্তব্য শুনে সবাই মোহিত হযে যায় ”
পরবর্তী কালে ২০০৪ সালে ফের আচার্য রুপে শান্তিনিকেতনে আসেন অটল বিহারী বাজেপেযী। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ নোবেল চুরি হযে গেছে বলে জানা যায়। দেশ তোলপাড় হতে থাকে। আচার্য চুপ করে থাকতে পারেন নি। কবির নোবেল চুরির খবর পেযে আর এক কবি আচার্য প্রধানমন্ত্রী নিজে ফোন করেন উপাচার্য সুজিত বসুকে। নিজের উদ্যোগে আগ্রহে আসার কথা জানালেন। সুজিত বসু বলেন, উনি নিজে আমাকে ফোন করলেন। বললেন আমি নিজে যাব। ২ এপ্রিল এলেন শান্তিনিকেতনে এসে নোবেল চুরির ঘটনায় সিবিআই তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য হাইপাওযার কমিটির পরামর্শ মত অর্থ সাহায্য করলেন আচার্য।রবীন্দ্র সম্পদ রক্ষার জন্য তৎপরতা দেখাতেন | উনি আচার্য থাকাকালীন অবাধে বিশ্বভারতী নিযে প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে কথা বলা যেত। কোন আমলা মারফৎ যেতে হত না। উনি বিশ্বভারতীর প্রতি এতটাই আগ্রহী ছিলেন।তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে একাধিকবার বিশ্বভারতীর বিভিন্ন প্রসঙ্গ লোকসভায় আলোচিত হয়েছে।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাকে এতটাই আকর্ষন করত যে কবির “ভারত তীর্থ” কবিতা হিন্দি অনুবাদ চেয়েছিলেন বন্ধুর কাছে। শান্তিনিকেতনের বন্ধু অটল বিহারী বাজপেয়ির সহপাঠী ছিলেন বিশ্বভারতীর হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক রামসিং তোমার। তাঁকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন গুরুদেবের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার হিন্দি অনুবাদ করে দিতে। সেইমতো বাংলা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান রামবহাল তিওয়ারির সহযোগিতায় ওই কবিতা হিন্দিতে অনুবাদ করে বাজপেয়িকে দেওয়া হয়েছিল।