বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারের ঢালাও কর্ম পরিকল্পনা রাজ্যপালের ভাষণে

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৩ মার্চ ৷৷ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের ছক রাজ্যপালের ভাষণেই এঁকে দিয়েছে বিজেপি- আইপিএফটি জোটের নতুন

শুক্রবার বিধানসভায় ভাষণ দেন রাজ্যপাল তথাগত রায়৷ ছবি নিজস্ব৷

সরকার৷ দ্বাদশ বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনে রাজ্যপাল ভাষণে নতুন সরকারের কর্ম পরিকল্পনার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন৷ কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উপজাতি কল্যাণ এবং অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নতুন সরকারের লক্ষ্যের একটি রূপরেখা সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন করেন তিনি৷ তাঁর কথায় শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রেখে রাজ্যের প্রতিটি নাগরিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে নতুন সরকার রাজ্যের উন্নয়নে গৃহীত সুসংহত কর্মসূচির আন্তরিক বাস্তবায়নের পরিপূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ রাজ্য ও জনগনের সার্বিক অগ্রগতিতে এই সরকার রাজ্যের সমস্ত কর্মকান্ড দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করতে অঙ্গিকারবদ্ধ৷

প্রথা অনুযায়ি ইংরেজী বছরের প্রথম অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন রাজ্যপাল৷ প্রথা মেনে রাজ্যপাল তথাগত রায় এদিন বিধানসভায় ভাষণ রাখেন৷ রাজ্যপালের কথায়, রাজ্যের জনগণের কর্মসংস্থান বর্তমান রাজ্যসরকারের সর্বাধিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র৷ বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প ইউনিটের পুনরুজ্জীবন, নতুন শিল্প স্থাপন, বিদেশী ও স্বদেশী বিনোয়গকারীদের আনয়ন, তথ্য – প্রযুক্তি শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দান এবং স্ব-উদ্যোগী শিল্প স্থাপনের সুবিধাদান ইত্যাদি বহুমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একটি কর্মসংস্থান প্রদানের জন্য রাজ্য সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ৷ তাঁর বক্তব্য, বেকারদের স্কিল ইন্ডিয়া মিশনের আওতায় প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা এবং দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল্য যোজনার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বিকাশের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷ সাথে যোগ করেন, ব্যবসার জন্য আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হবে৷ সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেকটি প্রযুক্তি ও পেশাগত প্রতিষ্ঠানে প্লেইসমেন্ট সেল স্থাপন করার প্রস্তাব রয়েছে৷ রাজ্যপাল আশা প্রকাশ করে বলেন, রাজ্যের কর্মবিনিয়োগ  কেন্দ্রগুলিকে আরো উন্নত এবং ডিজিটাইজড করে তোলা হবে৷ এরই পাশাপাশি বলেন, বেকার ইঞ্জিনিয়ার ও স্নাতকোত্তর ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি প্রাপ্ত বেকারদের সরকারি কণ্ট্রাক্ট নেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে৷ স্বসয়াক দলের জন্য সুদ বিহীন স্বল্প মেয়াদি ঋণ প্রকল্প চালু করা হবে৷

রাজ্যপাল এদিন কৃষি ও কৃষক কল্যাণে পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেছেন৷ তাঁর কথায়, কৃষকদের উন্নয়ন ও ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে৷ কৃষক বন্ধু কেন্দ্র গড়ে  তোলার পাশাপাশি এগ্রিক্লিনিক্স ও কৃষি ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলতে উৎসাহ দেওয়া হবে৷ কৃষকদের জন্য বাৎসরিক ভূমি পরীক্ষা কার্ড প্রদান সুনিশ্চিত করা হবে৷ এরই পাশাপাশি কম খরচে কোল্ড স্টোরেজ সেবা ও গোদাম ঘরের ব্যবস্থা করার হবে৷ উচ্চ ফলশীল বীজ ও সাড় একসাথে বেশি পরিমাণে ক্রয় করে কৃষকদের মধ্যে বন্টন করারও একটি প্রকল্প চালুর প্রস্তাব রয়েছে৷ রাজ্যপালের কথায় কৃষি, উদ্যান ও বনায়নের সর্বশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ ও এর প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তির বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য একটি কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় ও কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র গড়ে তোলারও প্রস্তাব রয়েছে৷ তাঁর দাবি, জৈব চাষাবাদকে উৎসাহ প্রদান ও জনপ্রিয় করে তুলতে ত্রিপুরা অর্র্গনিক সার্টিফিকেশন এজেন্সি এবং চা, রাবার ও বাঁশ চাষের বিজ্ঞান ভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ডাইরেক্টরেট গড়ে তোলারও প্রস্তাব রয়েছে৷ বাঁশ ভিত্তিক শিল্পের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য রাজ্যসরকার একটি পৃথক নীতি প্রণয়ন করবে৷

রাজ্যপালের মতে, রাজ্যসরকার মানব সম্পদ উন্নয়নকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে৷ বর্তমান শিক্ষা পরিকাঠামোকে আরোও প্রসারিত ও শক্তিশালী করে তুলবে রাজ্যসরকার৷ গুণগত শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সামগ্রি রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে প্রদান করার জন্য এই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে৷ পাশাপাশি রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ককবরক, চাকমা ও মণিপুরী ভাষাকে আরোও বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ করা হবে৷ সাথে যোগ করেন, বিশ্ব বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষাকেও ককবরক ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষা চালু করবে রাজ্য সরকার৷ রাজ্যপাল বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে সমন্বয় সাধন, সংকল্প সাধন ও শিক্ষার মান বজায় রাখার জন্য একটি সরকারি সংস্থা গঠন করার প্রস্তাব রয়েছে৷

শিক্ষার পাশাপাশি সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানেও রাজ্যসরকার অঙ্গীকার বদ্ধ, উল্লেখ করেন রাজ্যপাল৷ তাঁর কথায়, রাজ্যে ট্রমাকেয়ার সুবিধাযুক্ত পর্যাপ্ত সংখ্যায় মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল এবং এইম্সের মতো উন্নত প্রযুক্তির হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাবে রাজ্যসরকার৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয়ে একটি রিমস্ স্তরের নতুন আঞ্চলিক মেডিক্যাল স্থাপন করবে এই সরকার৷ সাথে  যোগ করেন, ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকায় অন্তত একটি মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেবে রাজ্যসরকার৷ আগরতলাস্থিত ক্যান্সার হাসপাতালের উন্নয়ন এবং আমবাসায় আরোও একটি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলারও প্রস্তাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যপাল৷ এরই সাথে সরকার আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, ন্যাচারোপ্যাথির মত বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতিও উৎসাহ যোগাবে৷ এজন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে আয়ুষ হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে৷ তাঁর বক্তব্য, প্রতিটি দরিদ্র মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার সকলরকম সুযোগ প্রদানে সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ৷

রাজ্যপাল বলেন, ইজ অব ডুয়িং বিসনেজের ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি ঘটানোর পাশাপাশি ভারত সরকার প্রবর্তিত মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পটিকে ত্রিপুরায় বাস্তবরূপ দিতে রাজ্যসরকার সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে৷ রাজ্যে শিল্প স্থাপনের জন্য শিল্পোদ্যোগীদের আকৃষ্ট করতে ও উৎসাহ দিতে আকর্ষনীয় সুগোয সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে৷  রাজ্যে স্বউদ্যোগকে উৎসাহিত করতে স্টার্ট অ্যাপ ত্রিপুরা নামে একটি নীতি প্রণয়ন করা হবে৷ বাঁশ, বেত, কারুশিল্প ও হস্ততাঁতের মতো ঐতিহ্যবাহি কুটির শিল্পের পাশাপাশি সার শিল্পের মতো প্রকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া হবে৷ সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে স্থানীয় জনগনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সুনিশ্চিত করবে রাজ্য সরকার৷

পর্যটনকে কেন্দ্র করে রাজ্যে বিরাট সম্ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতে ভারত সরকারের সাথে সমন্বয়ে নর্থ ইস্ট সার্কিটকে আরোও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেবে রাজ্য সরকার৷ রাজ্যের ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এই গোঁটা অঞ্চলে লজেস্টিক হাব গড়ে তোলার সবরকম প্রচেষ্টা চালাবে সরকার, দৃঢ় বিশ্বাস রাজ্যপালের৷

সকল অংশের মানুষের জন্য সমানভাবে কাজ করবে রাজ্য সরকার৷ এই দাবি করে রাজ্যপালের বক্তব্য, সমাজের  দুর্বলতর অংশের মানুষের আর্থসামাজিক ও শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে রাজ্য সরকার৷ তাঁর কথায়, তপশীলি জাতি, তপশীলি উপজাতি, অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণী, সংখ্যালঘু ও দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবার গুলির উন্নয়নে বিশেষ করে তাঁদের শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, দারিদ্র্য দুরিকরণ এবং উদ্যোগী দক্ষতার উন্নয়নে এই সরকার একটি সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরী ও বাস্তবায়ন করবে৷ তাঁর মতে, সবাইকে সাথে নিয়ে সবার উন্নয়ন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজ্য সরকার ত্রিপুরার আদিবাসী জনগনের আর্থ- সামাজিক, ভাষাগত ও সামাজিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে অঙ্গিকার বদ্ধ৷ এই রাজ্যের উপজাতি সম্প্রদায় সামাজিক, আর্থিক, সাংসৃকতিক এবং ভাষার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে তার সমাধানের লক্ষ্যে রাজ্যসরকার, ভারত সরকারের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করবে এবং সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বর্তমান সরকার পদক্ষেপ নেবে৷ রাজ্য সরকার ভারতের সংবিধানের অষ্টম তপশীলে ককবরক ভাষাকে অর্ন্তভুক্ত করার ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাজ্য সরকার৷ সাথে যোগ করেন, বিভিন্ন জাতিয় ও আর্ন্তজাতিক সভায় আদিবাসীদের পারম্পরিক সঙ্গিত ও নৃত্যের বিকাশে উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে ত্রিপুরার রাজাদের কাহিনীগুলি অর্ন্তভূক্ত করবে রাজ্য সরকার৷

দক্ষ, স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ সরকার প্রদানে অঙ্গিকারবদ্ধ রাজ্য সরকার, এদিন প্রত্যয়ের সাথে বলেন রাজ্যপাল৷ তাঁর কথায়, রাজ্য সরকার দুর্নীতি বিষয়ে কোনও সহনশীলতা দেখাবেনা এবং সমস্ত দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় কঠোর ব্যবস্থা নেবে৷ সরকারী দফতরগুলির কাজকর্মের বাৎসরিক অডিট করবে রাজ্য সরকার৷

এদিন রাজ্যপাল দাবি করেন, ত্রিপুরাকে একটি অপরাধ মুক্ত রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলবে বর্তমান সরকার৷ এক্ষেত্রে মহিলাদের নিরাপত্তা সরকারের কাছে অগ্রাধিকারের বিষয়৷ তাঁর কথায় এব্যাপারে কঠোর আইন পাশ এবং রাজ্যের মহিলা সংক্রান্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে রাজ্য সরকার৷ তাঁর দাবি, আর্ন্তজাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে সংগঠিত অপরাধ দমনের লক্ষ্যে রাজ্য আরক্ষা বাহিনীতে একটি বিশেষ বর্ডার এরিয়া ইউনিট গঠন করা হবে৷ রাজ্যে উৎকোচ ও দুর্নীতি কান্ড দুরিকরণের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন শাখাও গঠন করবে রাজ্য সরকার৷ সাথে যোগ করেন, রাজ্যবাসী যাতে দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে ন্যায়বিচার পেতে পারেন সেজন্য রাজ্য সরকার রাজ্যে ন্যায়বিচার প্রদান পদ্ধতিকে সুদৃঢ় করে তুলতে প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে৷