দু’দিনের জেল হাজতে মামা, তদন্তে সিআইডি, আদালতেও বিক্ষোভ আনোয়ারা ছাত্র সমাজের

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৩ মে৷৷ শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরার আরও একটি ছাত্র আন্দোলনের জয় হল৷ মহিলা পলিটেকনিক

আনোয়ারা চৌধুরীর মামা নুর মহম্মদকে শনিবার আদালতে তোলা হয়৷ ছবি নিজস্ব৷

কলেজের ছাত্রী আনোয়ারা চৌধুরীর কথিত হত্যা কান্ডের সাথে যুক্ত বলে অভিযুক্ত তার মামাকে শনিবার আদালত ২ দিনের জন্য বিচারবিভাগীয় হেপাজতে পাঠিয়েছে৷ এদিকে, এই মামলার তদন্তভার সিআইডি’র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷
আনোয়ারা চৌধুরীর মামা তথা এলাকার বিশিষ্ট সিপিআইএম নেতা নুর মহম্মদ এবং তার স্ত্রীকে শুক্রবার পশ্চিম মহিলা থানার পুলিশ আচমকাই তুলে আনে৷ তাদের দিনভর জিজ্ঞাসা বাদের পর উভয়কেই পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ রাতে নুর মহম্মদকে গ্রেফতার করে শনিবার আদালতে হাজির করে পুলিশ৷ শুক্রবার রাতে নুর মহম্মদ গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি অন্য খাতে মোর নিতে থাকে৷ আদালতে পুলিশ অভিযুক্তকে ৭ দিনের জন্য পুলিশী হেপাজতে পাঠানোর আবেদন করে৷ কিন্তু পুলিশ এদিন কেইস ডাইরি জমা করতে পারেনি৷ ফলে অভিযুক্তকে সোমবার পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেপাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ পশ্চিম ত্রিপুরার পুলিশ সুপার অভিজিত জানিয়েছেন, ফরেনসিক ল্যাবের রিপোর্ট আসার পর বোঝা যাচেছ, আনোয়ারা চৌধুরীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট আসার পরেই পুলিশ এবিষয়ে সুনিশ্চিত হয়েছে আনোয়ারা চৌধুরীর মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা নয়৷ মৃত্যুর পর ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে আনোয়ারার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে৷ কিন্তু এখন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে৷ এর পরেই মৃতার মামাকে শুক্রবার পশ্চিম মহিলা থানার পুলিশ আচমকাই তুলে আনে৷ দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর উভয়কেই পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয় আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য৷ তার বক্তব্যে বিস্তর অসংলগ্ণতা ধরা পরে এবং এর পরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

আদালত চত্বরে আনোয়ারার সহপাঠীদের ধর্ণা ৷ ছবি নিজস্ব৷

এদিকে আনেয়ারা চৌধুরীর সহপাঠীরা শনিবার আদালত চত্বরেও হাজির হয়৷ তাদের বক্তব্য, খুনিদের হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত৷ তারা দাবী করেছে, আনোয়ারার চিকিৎসককেও গ্রেপ্তার করতে হবে৷ কারণ সে প্রত্যক্ষ ভাবে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত৷ এবিষয়ে যুক্তি, হাসপাতালে সবকিছু সঠিকভাবে চললে, মৃত্যুর পর ময়না তদন্তের রিপোর্টে আনোয়ারার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলা হতনা৷ সত্যটা তখনই বেরিয়ে আসত৷ ছাত্র ছাত্রীরা আরও দাবি করেছে, এই ঘটনার তদন্ত ফাষ্টট্রেক কোর্টে করতে হবে৷

উল্লেখ্য, এক মাস আগের এই হত্যা কান্ড নিয়ে সারা রাজ্যে ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল৷ একই সঙ্গে পুলিশী ব্যর্থতা এবং শাসক দলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠতে থাকে৷ এই অবস্থায় শুক্রবার পুলিশ আনোয়ারা চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের জন্য তার নিকট আত্মীয়দের দুজনকে থানায় তুলে আনে৷ তাদের দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর উভয়কেই পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে রাজ্য পুলিশের ডি আই জি অরিন্দম নাথের নেতৃত্বে পুলিশ আধিকারিকদের একটি দল আনোয়ারা চৌধুরীর মামা তথা এলাকার বিশিষ্ট সিপিআইএম নেতা নুর মহম্মদ এবং তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ রাত বাড়তেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরিবারের তরফে শারীরিক অসুস্থতার কারনে আনোয়ারা মৃত্যুর কথা বলা হলেও তার সহপাঠীরা হত্যার এবং তার মামা ও অন্যান্য আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছে৷

রাজ্য পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, নুর মহম্মদের জিজ্ঞাসাবাদের পর্বে পুলিশ অনেক কিছু জানতে পেরেছে৷ তবে আনোয়ারা চৌধুরীর মৃত্যুর পেছনে অস্বাভাবিক কিছু বিষয় রয়েছে যা ময়না তদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে গেছে৷
আনোয়ারা ছোট বয়সেই মাতৃহারা হয়৷ মা এর জীবদ্দশাতেই তার পিতা একাধিক বিয়ে করেন৷ মায়ের মৃত্যুর পর অসহায় আনোয়ারা প্রথমে তার দিদার কাছে লালিত পালিত হয়৷ দিদার মৃত্যুর পর মামা মামির কাছেই থাকত আনোয়ারা৷ তবে আনোয়ারার নামে বিস্তর সম্পত্তি ছিল৷ আঠার বছর বয়স হলেই আনোয়ারা এই সম্পত্তির মালিক হত৷ কিন্তু এর কিছুদিন আগেই আনোয়ারার রহস্য জনক মৃত্যু হয়৷ সহপাঠীদের অভিযোগ, মামা সহ বেশ কয়েকজন আত্মীয়পরিজন এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে যুক্ত৷ কিন্ত মামা শাসক দলের নেতা এবং যথেষ্ট ক্ষমতাবান৷ তাই পরিকল্পনা মাফিক সব হয়েছে এবং হাসপাতালও সে সময় তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল৷

এই ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার সকাল প্রায় নয়টা নাগাদ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের একদল কর্মী আচমকা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সরকারি আবাস ঘেরাও করে ফেলে৷ প্রায় ২০০ কর্মী সমর্থক মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাসের বাইরে থাকা ব্যারিকেড ভেঙে মূল ফটকের সামনে চলে যায়৷ তারা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীতে শ্লোগান ও দিতে থাকে৷ উল্লেখ্য, করা যেতে পারে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের কাছে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বও রয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাসকে ঘেরাও মুক্ত করতে পুলিশকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়৷

এর আগের দিন বুধবার রাতে আনোয়ারা চৌধুরীর মৃত্যুর এক মাস হতেই সহপাঠীরা সিটি সেন্টারের সামনে জড়ো হয়ে মিছিল করে রবীন্দ্র ভবনের সামনে আসে এবং তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি খেলাপের অভিযোগ তুলে রাজপথ অবরোধ করে৷ পরে স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ নাগরিকও তাদের সঙ্গে সামিল হন৷ ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগ, পুলিশে কথার খেলাপ করছে৷ পুলিশ খুনিদের আড়াল করতে চাইছে৷ প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু এই সময়সীমা আরও আগেই পার হয়ে গেছে৷ এমনকি আনেয়ারা চৌধুরীর মৃতদেহ কবর থেকে তুলে ময়না তদন্ত করার পরেও তার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হয়নি৷ পরবর্তী সময়ে পথ অবরোধ শুরু হতেই পুলিশ প্রশাসনে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়৷ আরও ৭ দিনের সময় চেয়ে পুলিশ আধিকারিকরা ছাত্র নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু এ নিয়ে দীর্ঘ তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে৷ আনোয়ারা চৌধুরীর সহপাঠীরা এই বিষয়ে এবার পুলিশকে লিখিত আকারে আশ্বাস দেবার দাবী করতে থাকে৷ পুলিশ এতে রাজি হয়নি৷ উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কথা কাটাকাটি চলে৷ পরে প্রবীণদের হস্তক্ষেপে আনোয়ারা চৌধুরীর সহপাঠীরা অন্তিম বারের মত পুলিশকে ৭ দিনের সময় দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়৷ তবে সে দিন ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া চরম সময়সীমা এবং পরিস্থিতির চাপে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে৷

মৃত্যুর পর ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে আনোয়ারার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে৷ অথচ মর্গ সূত্রে জানা গিয়েছিল মৃতার গোপনাঙ্গে জমাট বাধা রক্ত ছিল৷ কবর দেবার সময় দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত ঝরছিল৷ কিন্ত সে বিষয়ে কোন উল্লেখ ছিলনা ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে৷ এক্ষেত্রে মামালার তদন্তকারী অফিসার জিবি হাসপাতালের কাছে চিকিৎসার কোন গাফিলতি ছিল কিনা সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল৷ সে জন্য জিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে৷ কথা ছিল ৩ দিনের মধ্যে তারা রিপোর্ট জমা দেবে চিকিৎসার গাফিলতি আছে কিনা তা জানিয়ে৷ কিন্তু জিবি হাসপাতাল থেকেও এ সংক্রান্ত কোন রিপোর্টই এখনো দেওয়া হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে৷ তাতে জিবি হাসপাতালের ভূমিকা নিয়েও বিভিন্ন মহলে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে৷

পুুলিশের বক্তব্য, ৯ এপ্রিল সকালে আনোয়ারার বমি ও পেট ব্যথা শুরু হয়৷ তখন তাকে আইজিএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ডাক্তার তাকে দেখে কিছু ঔষুধ লিখে দেন৷ ঔষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমে যায়৷ এরপর আনোয়ারা বাড়ি চলে যায়৷ কিন্তু বিকালেই আবার পেট ব্যথা শুরু হলে বর্তমান দিদা তার বাবাকে খবর দেন৷ বাবা এসে আনোয়ারাকে জিবি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যায় এবং তাকে ভর্তি করে চলে আসেন৷ এরপর রাত সোয়া বারোটায় আনেয়ারা মারা যায়৷ অন্যদিকে তার ডেথ ডিক্লারেশনে চিকিৎসক লিখেছেন হার্ট অ্যাটাক৷ এইদিকে আনোয়ারা মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেকে তাকে দেখতে গিয়েছিল কিন্তু কাউকেই মৃতদেহের পাশে যেতে দেওয়া হয়নি৷ কবর দেওয়ার পর বাড়ির সবাই স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল বলে অভিযোগ৷ তবে জানা যায়, আনোয়ারার আত্মীয় পরিজনদের অনেকেই এলাকার সমাজদ্রোহী হিসাবে পরিচিত৷ পলিটেকনিক কলেজের ছাত্রী আনোয়ারা চৌধুরীর রহস্য মৃত্যুর ঘটনার সঠিক তদন্তের দাবী নিয়ে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র ছাত্রীদের সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হয় তার মৃত্যুর ঠিক পরেই৷ বামপন্থী সংগঠন প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পরায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়৷ অন্যদিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের নাম ধাম সহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়৷ ছাত্র নেতা কৌশিক দাস শনিবার অভিযোগ করেছেন, আনোয়ারা চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করছিলোনা এতদিন৷ এখন তারা কি করতে চাইছেন তা সময় বলবে৷ পুলিশ বিভিন্ন সময় প্রতিবাদে শামিল হওয়া ছাত্রছাত্রীদেরকে নানাভাবে হুমকি ধমকি দিয়েছে৷ রাজধানীতে এনিয়ে কয়েকটি পর্যায়ে আন্দোলন হয়৷ শহরে মোমবাতি মিছিলও হয়৷ রাজ্যে ছাত্র আন্দোলনের বিস্তর ইতিহাস রয়েছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সফলও হয়েছে৷ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের নেতাই ছিলেন৷ আর আনোয়ারাকে নিয়ে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলন অবার রাজ্যবাসীকে নয়া দিশা দেখাল বলে মনে করছেন রাজ্যের বুদ্ধিজীবী মহল৷