গুয়াহাটি, ০২ অক্টোবর, (হি.স.) : অবশেষে গ্রেফতার হলেন কৃষক মুক্তি সংগ্ৰাম সমিতির নেতা অখিল গগৈ। আজ রবিবার স্থানীয় গান্ধীবস্তিতে সংগঠনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যখন বক্তব্য পেশ করছিলেন তখন দলবল নিয়ে চাঁদমারি পুলিশর এক দল এসে তাঁকে গ্রেফতার করে। সাংবাদিক সম্মেলনে কাজিরঙায় উচ্ছেদের শিকার মানুষজনদের পক্ষে সওয়াল করে রাজ্য পুলিশ ও রাজ্যের বিজেপি জোট সরকারকে তাঁক গ্রেফতার করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছিলেন অখিল। গ্রেফতারের পর তিনি পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ালেও জনতার কাছ থেকে দূরে থাকেননি বলে নিজের মুখে স্বীকার করেছেন তিনি। তাঁকে গ্রেফতার করে প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করার চক্রান্ত করছে সরকার ও তার পুলিশ বলে অভিযোগ তুলেছেন অখিল গগৈ।
গান্ধীবস্তিতে গ্রেফতারের পর থেকে অখিলকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদমারি থানায়। সেখান থেকে বিকেলে কাজিরঙার সদর জেলা নগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। কেননা নগাঁওয়ের জখলবন্ধা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর কাজিরঙা জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন তিনটি গ্রামে উচ্ছেদে গেলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তব্যে বাধা দেওয়া ও কাজিরঙায় উচ্ছেদের শিকার মানুষজনকে প্ররোচনা ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। সেদিন কাজিরঙার বান্দরডুবি গ্রামের মানুষজনকে তাতিয়ে মারমুখি করে তুলেছিলেন গগৈ। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে সেদিন থেকে থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন অখিল। তাঁকে গ্রেফতার করতে রাজ্যের নানা প্রান্তে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছিল পুলিশ ও সিআরপিএফ।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কাজিরঙা সংলগ্ন বান্দরডুবি গ্রামে জবরদখলদারিদের উচ্ছেদ অভিযানে সৃষ্ট অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এক মহিলা-সহ দুজনের মৃত্যু ও অন্য বহু নাগরিক জখম হয়েছেন। এ-ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের কয়েকটি অঞ্চলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
গুয়াহাটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে কাজিরঙা সংলগ্ন তিনটি গ্রাম বান্দরডুবি, পালখোয়া এবং দেওচূড়চাঙে উচ্ছেদ অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। পালখোয়া ও দেওচূড়চাঙের উচ্ছেদ অভিযানে বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রসাসনকে সহায়তা করলেও বিগড়ে বসেন বান্দডুবির বাসিন্দারা। প্রায় দশটি হাতি এবং এসকেভেটর নিয়ে পুলিশ-সিআরপিএফ-এর দল গ্রামের দিকে এগোলে তাঁদের বাধা দেন বাসিন্দারা। উচ্ছেদের আগের রাতেই রাস্তায় ফেলে রাখা বিশাল বিশাল গাছ সরিয়ে তাঁরা যখন এগোচ্ছিলেন তখন পুলিশ ও সিআরপিএফ-এর ওপর ছোঁড়া হয় ইট-পাটকেল। এতে কয়েকজন জওয়ান আহত হন।
উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে লাঠি চার্জ এবং পরে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে পুলিশ। এর পর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বেসামাল। অঝোরে পাথরবৃষ্টি হতে থাকে প্রশাসনের লোকজনদের ওপর। বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে শূন্যে গুলি ছুঁড়তে হয়েছে। ইত্যবসরে পূর্ত সড়কে এক মহিলা ও খানিক দূরে মাঠে ফকরউদ্দিন নামের এক যুবক ও অঞ্জুমা খাতুন নামের এক মহিলার লাশ উদ্ধার হলে আরও দ্বিগুণ ক্ষেপে যান বাসিন্দারা। পরিস্থিতি যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নেয়।
এদিকে নাছোড় প্রশাসনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত এক সময় ১৯০ জনের গ্রামকে জবরদখলমুক্ত করে ফেলা হয়।
এদিকে উদ্ভূত এ-ঘটনার পেছনে তৃতীয় শক্তির হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে। ওই তৃতীয় শক্তিই গ্রামের বাসিন্দাদের প্ররোচনা বা উসকানি দিয়ে পুলিশ বা সাধারণ প্রশাসনের ওপর লেলিয়ে দিয়েছে। তৃতীয় শক্তি বলতে সরাসরি কৃষক নেতা অখিল গগৈকেই টার্গেট করা হচ্ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের কাজে বাধা দেওয়া ও জনতাকে প্ররোচনা তথা উকসানি দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিযাগ তোলে খুব শীঘ্র অখিল গগৈকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। পলাতক অখিলের বিরুদ্ধে চোরের মতো পালিয়ে বেড়ানোর অভিযাগ তুলেছিলেন বনমন্ত্রী প্রমিলারানি ব্রহ্মও। মন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, সাহস থাকলে জনসমক্ষে বেরিয়ে আসুন অখিল, ধরা দিন পুলিশের হাতে।
অখিল গগৈয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যুক্তি, উচ্ছেদের আগের দিন এই বান্দরডুবিতে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে অখিল গগৈ রাজ্য সরকার, গুয়াহাটি উচ্চ আদালতের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশকে একটি ঐতিহাসিক অন্যায় বলে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে মরণ-পণ সংগ্রামের সংকল্প নিয়েছে তাঁর সংগঠন কৃষক সংগ্রাম সমিতি। এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তাঁর অ-সম সংগ্রাম। এদিন জনতাকে উসকে দিয়ে তিনি নাকি আরও বলেছিলেন, মুসলিমদের উচ্ছেদ করে সরকার বাহবা কুড়োচ্ছে, এটা বিজেপি সরকারের পরিকল্পিত কর্মসূচি। বান্দরডুবি ও দেওচূড়চাং গ্রামে রয়েছেন প্রায় ৬০০ জন, আর আজ (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে মোতায়ন করা পুলিশ-ব্যাটালিয়নের সংখ্যা প্রায় ১৮০০। তাঁর ব্যাখ্যা, নিরীহ নিরস্ত্র একেকজন নাগরিকদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তিনজন করে সশস্ত্রবাহিনী। বিশালসংখ্যক সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করে নিরস্ত্র মানুষ কখনও জয়ী হতে পারবেন না। তবু স্থানীয় কয়েকশো কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে অ-সম সংগ্রামে কৃষকমুক্তির নেতৃবর্গ বীরত্ব প্রদর্শন করবেন।